শোভনলাল চক্রবর্তী
‘লঙ্গিচিউডিনাল এজিং স্টাডি অব ইন্ডিয়া’ (এল এ এস আই)-এর প্রথম ধাপের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫ শতাংশ প্রবীণ পরিবার বা পরিচিতের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। এর চেয়ে অনেক বড় সেই শূন্যতা— যেখানে অধিকাংশ প্রবীণই মুখ খোলেন না। কেন? সম্পর্ক হারানোর ভয়ে, সামাজিক লজ্জা বা আইনগত জটিলতার আশঙ্কায়। বহু সময়ে পরিজনেরাই বুঝতে পারেন না যে, তাঁরা প্রবীণদের মানসিকভাবে আঘাত করছেন বা যত্ন থেকে বঞ্চিত করছেন। যেমন, অবিরত অভিযোগ করা, খারাপ ব্যবহার করা, চিকিৎসা না করানো, সময় না দেওয়া— এ সবই প্রবীণ নির্যাতনের মধ্যে পড়ে, অনেক সময়ে এই ব্যবহারগুলো অজান্তেই হয়ে যায়।
বিশেষত, যাঁরা ডিমেনশিয়া বা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন, যাঁদের আর্থিক বা প্রযুক্তিগত সচেতনতা কম বা শারীরিকভাবে নির্ভরশীল— তাঁরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। চিন্তার কথা হল— প্রবীণেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতিত বোধ করেন যাঁদের ব্যবহারে, তাঁরা তাঁদেরই প্রিয়জন। যার প্রভাব পড়ে শারীরিক স্বাস্থ্যে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ও মৃত্যুর হারে। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা দীর্ঘদিন মানসিক বা সামাজিক অবহেলার শিকার, তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ে। তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতাও হয়তো থাকে না, ফলে কষ্ট চুপিসাড়ে থেকে যায়।
বহু ক্ষেত্রেই প্রবীণ নির্যাতনের লক্ষণ বুঝতে পারি না। কারণ আমাদের দৃষ্টিতে এটি গুরুতর সমস্যা নয়। অথচ, কিছু সাধারণ লক্ষণ যদি নজরে রাখি, তবে এই নির্যাতনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন, আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন, অকারণে কান্না, অজানা ভয়, খাওয়ায় অনীহা, শরীরে বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন, আর্থিক লেনদেনে অসামঞ্জস্য, কিংবা বারবার চিকিৎসা নিতে আসা, কিন্তু কিছু না বলা। সচেতন চোখ, সংবেদনশীল মন আর কান খোলা থাকলেই বোঝা যায়, সব ঠিক নেই।
প্রবীণদের প্রতি এই ব্যবহার শুধু বাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে, পথেঘাটে, বাসে, ট্রেনে, স্টেশনে, ব্যাঙ্কে, অফিসে দৈনন্দিন জীবনে এ রকম ব্যবহার দেখা যায়।
ভারতের আইনগত পরিকাঠামোয় এই সমস্যার স্বীকৃতি রয়েছে। ‘মেন্টেনেন্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজ়েন্স অ্যাক্ট, ২০০৭’ অনুযায়ী, সন্তান বা উত্তরাধিকারীরা তাঁদের বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য দায়বদ্ধ। প্রবীণেরা জেলা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মাসিক ভরনপোষণের আবেদন করতে পারেন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন। তবে এই আইনের প্রয়োগ সীমিত। অধিকাংশ মানুষ আইনের কথা জানেন না, জানলেও প্রয়োগে ভয় পান। কিছু দিন আগে মুক্তি পাওয়া রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘সন্তান’ ছবিটি এই বিষয়টি সামনে এনেছে এবং এই আইনের ব্যবহারকেও তুলে ধরেছে।
সমস্যার সমাধান কেবল আইন দিয়ে সম্ভব নয়। সমাধান করতে হবে সমাজিক ও পারিবারিকভাবে এবং একসঙ্গে। প্রবীণদের সম্মান দেওয়া, মতামত শোনা, দৈনন্দিন সিদ্ধান্তে তাঁদের যুক্ত রাখা এবং সময় দেওয়া— এ সবই নির্যাতন প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ছোট থেকেই বাবা-মা, দাদু-ঠাকুরমার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলে এই সমস্যা কমবে।
তাঁদের প্রয়োজনে কাউন্সেলিং, সাপোর্ট গ্রুপ বা সমাজসেবী সংস্থার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। প্রবীণদের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস জাগানো, ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ দেওয়া এবং তাঁদের স্বাস্থ্য ও আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।
বহু ক্ষেত্রে পরিচর্যাকারীর মনের ক্লান্তি, আর্থিক চাপ, নিজের অসুস্থতা বা সহানুভূতির অভাব থেকেও প্রবীণ নির্যাতন ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারিবারিক আলোচনা বা তৃতীয় পক্ষের সহায়তা নেওয়া যায়।
প্রবীণদের অবজ্ঞা করা মানে নিজের শিকড় কেটে ফেলা। তাই আমাদের দায়িত্ব, প্রবীণদের পাশে থাকা, তাঁদের সম্মান রক্ষা করে জীবনের শেষ অধ্যায়কে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলা। আজকের সমাজ যদি প্রবীণদের জন্য নিরাপদ হয়, তবে আগামিকাল আমাদের জন্যও নিরাপদ হবে। প্রবীণদের জন্য হোক এমন সমাজ, যা নিজেদের বার্ধক্যে প্রত্যাশিত— মর্যাদাপূর্ণ ও সহানুভূতিসম্পন্ন। সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রবীণ নাগরিক যেন যে কোনও প্রয়োজনে পুলিশকে সহজেই পাশে পান। কিন্তু, পুলিশের উপর যত কাজের চাপ এবং বাহিনীতে লোকসংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তাতে যাবতীয় সদিচ্ছা যোগ করলেও পুলিশের পক্ষে শহরের প্রবীণ নাগরিকদের প্রাত্যহিক দেখভাল করা অসম্ভব। সেটা পুলিশের কাজও নয়— তার কাজ শহরকে নিরাপদ রাখা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। বয়স্কদের নিরাপদে রাখার বন্দোবস্তটি আসলে বৃহত্তর সমাজেরই দায়িত্ব এবং তা হবে প্রশাসনিক নজরদারিতে। ভাড়াটে, গৃহকর্মীদের ছবি-পরিচয়পত্র, ঠিকানার প্রামাণ্য দলিল তাঁদের জ্ঞাতসারেই থানায় জমা দেওয়াকে সামাজিক অভ্যাস করে তুলতে হবে। অন্য দিকে, কর্মীকে বাড়িটি চিনিয়ে দিলেই লোক সরবরাহের এজেন্সির দায়িত্ব ফুরায় না। রেজিস্ট্রেশন বিধি সম্যক মেনে, পুলিশ এবং গ্রাহকের সঙ্গে অবিরত সংযোগ রাখতেই হবে তাদের। অভিযোগ এলে যথাযথ ব্যবস্থা করতে বিলম্ব তাদের গাফিলতি হিসাবেই দেখতে হবে। সরকারের কর্তব্য, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা, যার কাজ হবে এই গোটা ব্যবস্থাটির উপরে নজর রাখা। কোনও তরফে গাফিলতি হলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা গোটা বিষয়টিকে কিছু জরুরি নিয়মের আওতায় আনবে, যাদের কাছে এজেন্সি দায়বদ্ধ থাকবে।
কিছু নাগরিককে বুঝতে হবে, এজেন্সির মধ্যস্থতাকে উপেক্ষা করে গৃহকর্মীকে সরাসরি বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করার অর্থ লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘন। প্রক্রিয়াটি থেকে বেরিয়ে এলে নিজের জীবন ও নিরাপত্তার ভার নিজেকেই বইতে হবে। সামান্য কিছু অর্থ বাঁচাতে এই ঝুঁকিগ্রহণ কতটা যুক্তিসঙ্গত, বিশেষত আজকের দুর্দিনে, সেটাও ভেবে দেখার। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ আবার ছোট ছোট নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে বিচ্ছিন্ন, স্বার্থসর্বস্ব হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কোভিডকালে প্রবীণদের পাশে দাঁড়ানোর যে সামাজিক চেতনা জাগ্রত হয়েছিল, সেই অনুভূতি আবার ফিরে আসা দরকার। পাড়া-প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য রক্ষা করলে, বিপদ-আপদে বয়স্কদের ঢাল হয়ে দাঁড়ালে সামাজিক রক্ষাকবচ তৈরি হবে, এতেও সুযোগসন্ধানীরা প্রবীণদের একা, অশক্ত ভাবা বন্ধ করবে ও কুচিন্তা প্রতিহত হবে। সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রবীণ নাগরিক যেন যে কোনও প্রয়োজনে পুলিশকে সহজেই পাশে পান। কিন্তু, পুলিশের উপর যত কাজের চাপ এবং বাহিনীতে লোকসংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তাতে যাবতীয় সদিচ্ছা যোগ করলেও পুলিশের পক্ষে শহরের প্রবীণ নাগরিকদের প্রাত্যহিক দেখভাল করা অসম্ভব। সেটা পুলিশের কাজও নয়— তার কাজ শহরকে নিরাপদ রাখা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। বয়স্কদের নিরাপদে রাখার বন্দোবস্তটি আসলে বৃহত্তর সমাজেরই দায়িত্ব, এবং তা হবে প্রশাসনিক নজরদারিতে। ভাড়াটে, গৃহকর্মীদের ছবি-পরিচয়পত্র, ঠিকানার প্রামাণ্য দলিল তাঁদের জ্ঞাতসারেই থানায় জমা দেওয়াকে সামাজিক অভ্যাস করে তুলতে হবে। অন্য দিকে, কর্মীকে বাড়িটি চিনিয়ে দিলেই লোক সরবরাহের এজেন্সির দায়িত্ব ফুরায় না। রেজিস্ট্রেশন বিধি সম্যক মেনে, পুলিশ এবং গ্রাহকের সঙ্গে অবিরত সংযোগ রাখতেই হবে তাদের। অভিযোগ এলে যথাযথ ব্যবস্থা করতে বিলম্ব তাদের গাফিলতি হিসাবেই দেখতে হবে। সরকারের কর্তব্য, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা, যার কাজ হবে এই গোটা ব্যবস্থাটির উপরে নজর রাখা; কোনও তরফে গাফিলতি হলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা গোটা বিষয়টিকে কিছু জরুরি নিয়মের আওতায় আনবে, যাদের কাছে এজেন্সি দায়বদ্ধ থাকবে।
কিছু নাগরিককে বুঝতে হবে, এজেন্সির মধ্যস্থতাকে উপেক্ষা করে গৃহকর্মীকে সরাসরি বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করার অর্থ লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘন। প্রক্রিয়াটি থেকে বেরিয়ে এলে নিজের জীবন ও নিরাপত্তার ভার নিজেকেই বইতে হবে। সামান্য কিছু অর্থ বাঁচাতে এই ঝুঁকিগ্রহণ কতটা যুক্তিসঙ্গত, বিশেষত আজকের দুর্দিনে, সেটাও ভেবে দেখার। অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ আবার ছোট ছোট নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে বিচ্ছিন্ন, স্বার্থসর্বস্ব হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কোভিডকালে প্রবীণদের পাশে দাঁড়ানোর যে সামাজিক চেতনা জাগ্রত হয়েছিল, সেই অনুভূতি আবার ফিরে আসা দরকার। পাড়া-প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ রক্ষা করলে, বিপদ-আপদে বয়স্কদের ঢাল হয়ে দাঁড়ালে সামাজিক রক্ষাকবচ তৈরি হবে, এতেও সুযোগসন্ধানীরা প্রবীণদের একা, অশক্ত ভাবা বন্ধ করবে ও কুচিন্তা প্রতিহত হবে। শহরের অনেক প্রবীণই এখন একা থাকেন। তাঁদের অনেকেই আর্থিক ভাবে সচ্ছল। সন্তানরা সুশিক্ষিত— তাঁরা ক্রমে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছেন, এই শহর তাঁদের ঊর্ধ্বগামী পেশাদার জীবন ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রবীণদের একা থাকার যন্ত্রণা যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাঁদের প্রতি অপরাধীদের কুনজর। গত কয়েক মাসে মহানগরে বারে-বারে আক্রান্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। কখনও শয্যাশায়ী প্রবীণের গলায় ছোরা ঠেকিয়ে লুট হয়েছে, কোথাও দীর্ঘ দিন ছক কষে ফেরিওয়ালা পরিচয়ে বাড়িতে ঢুকে বৃদ্ধাকে শ্বাসরোধ করে হত্যার খবর মিলছে। ভয় ধরিয়েছে নিউ গড়িয়ার ঘটনা। এজেন্সি দ্বারা নবনিযুক্ত আয়া পুরুষ সঙ্গী নিয়ে এসে বৃদ্ধকে বেঁধে রেখে, বৃদ্ধাকে খুন করেছে সম্পত্তি হাতানোর উদ্দেশ্যে। এই পরিস্থিতিতে ভাড়াটে, গৃহকর্মীদের তথ্য অনলাইনে স্থানীয় থানায় জানিয়ে রাখতে প্রবীণদের আবারও তাগাদা দিয়েছে পুলিশ। ‘প্রণাম’ প্রকল্পেও এমন তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু, শুধু তথ্যভাণ্ডার গড়েই কি বয়স্কদের রক্ষা করা সম্ভব?