জলবায়ুর সংকট: বিবেকের লড়াই

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

প্রকৃতিকে লুটে যারা মুনাফার সাম্রাজ্য গড়েছে, জলবায়ু মহাসম্মেলনের মঞ্চে আজ তারাই কোটি কোটি ডলার ঢালছে। শুনতে যেন অত্যন্ত মহৎ উদ্যোগ, কিন্তু বাস্তবে এর নেপথ্যে কাজ করছে আরও বড় ব্যবসার হিসাব। জলবায়ু পরিবর্তন যে বাস্তব, তা অস্বীকারের উপায় নেই এবং এটাও স্পষ্ট যে, এর পেছনে দায়ী বাজার অর্থনীতি ও কর্পোরেট শিল্পব্যবস্থা। তবুও সম্মেলনের সভাকক্ষে কর্পোরেটদের তৎপরতা কোনও পাপস্খালন নয়; বরং নতুন লাভের পথ খোঁজা।

গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনে জলবায়ু মোকাবিলার জন্য ১.৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল তৈরির কথা ঘোষণা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এর বড় অংশ খরচ হবে কার্বন নির্গমন কমানোর কাজে। আর এখানেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কর্পোরেটদের আগ্রহ, কারণ কম-নির্গমন প্রযুক্তি আগামী দিনের বিশাল বাজার। অর্থাৎ, প্রকৃতির বিপর্যয়েও তারা ব্যবসার সুযোগ দেখছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দুই ধরনের উদ্যোগ জরুরি—মিটিগেশন (কার্বন গ্যাস কমানো) এবং অ্যাডাপটেশন (পরিবর্তিত পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া)। কিন্তু কোনটিতে বেশি অর্থ যাবে তা নিয়ে বিতর্ক তীব্র। উন্নত বিশ্বের কর্পোরেটেরা চায়— বেশিরভাগ টাকা যাক মিটিগেশন প্রযুক্তির গবেষণায়, যাতে তারা নতুন বাজার দখল করতে পারে। অন্যদিকে, বিপন্ন মানুষদের নিয়ে উদ্বিগ্ন উন্নয়নশীল দেশগুলি চাইছে সেই তহবিল অ্যাডাপটেশনে ব্যবহার হোক, যাতে গরম, বন্যা বা সমুদ্রপৃষ্ট বৃদ্ধি— এসবের মধ্যে মানুষ অন্তত বাঁচতে পারে।
সবাই মিলে যেন ধরে নিয়েছে, টেকনোলজি আর সামান্য মানিয়ে নেওয়া দিয়েই জলবায়ু বদল রোখা সম্ভব। অথচ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না শিল্পসভ্যতার সেই লোভী কাঠামোর দিকে, যা প্রকৃতিকে শোষণ করেই টিকে আছে। প্যারিস চুক্তি বলে, বায়ুমণ্ডলে যতটুকু কার্বন থাকার কথা, তার ৮০ শতাংশ ইতিমধ্যেই মানুষ ঢেলে দিয়েছে, প্রধানত উন্নত বিশ্বের হাতেই এই অপরাধ।


সারা পৃথিবীতে ধনী ৯ শতাংশ মানুষের জন্য দায়ী ৫২ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস। আবার একশোটি বৃহৎ কোম্পানি মোট নির্গমনের ৭১ শতাংশ ঘটায়। অথচ জলবায়ুর সবচেয়ে বড় বোঝা বহন করছে সেই মানুষগুলো, যাদের নির্গমন প্রায় কিছুই নয়— মৎস্যজীবী, কৃষক, পরিযায়ী শ্রমিক, বস্তির বাসিন্দা।

ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবনে আজ প্রায় দুই কোটি মানুষ বিপন্ন। দিল্লির শ্রমিকরা তীব্র গরমে কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি— একদিকে আয় কমে, অন্যদিকে বাড়ছে বিদ্যুতের খরচ। উষ্ণায়ন সামলাতে আবার বাড়াতে হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, যার জন্য প্রয়োজন লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ। এই চক্রের কোনও শেষ নেই, ক্ষতি শুধু সাধারণ মানুষের।

এ কথা স্পষ্ট, ধনতন্ত্রের ব্যবসাই এখানে বড় চালক, ন্যায়ের প্রশ্ন নয়। প্রকৃতি শোষণের ইতিহাস, অতিলাভের সংস্কৃতি, সম্পদের কেন্দ্রীকরণ— এসবের সমালোচনা না করলে জলবায়ু সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়া অসম্ভব। তাই সমাধানের শুরু হওয়া উচিত সেই প্রশ্ন দিয়ে— কে দায়ী, আর কে ভুক্তভোগী?

যতক্ষণ পর্যন্ত শিল্পসভ্যতার লোভ-চালিত কাঠামো অক্ষত থাকবে, ততক্ষণ জলবায়ু সম্মেলন হবে, চুক্তি হবে, তহবিলও গড়ে উঠবে— কিন্তু প্রকৃতি বাঁচবে না, বাঁচবে না কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। জলবায়ু রক্ষার লড়াই তাই কেবল প্রযুক্তির নয়, এটি ন্যায়ের লড়াই, অর্থনৈতিক সমতার লড়াই এবং মানবিক বিবেকের লড়াই।