স্বপনকুমার মণ্ডল
পত্রপত্রিকার মাধ্যমেই শারদ সাহিত্যের আগমন। কিন্তু ঠিক কোন সময় থেকে এবং কোন পত্রিকায় স্বতন্ত্রভাবে প্রথম শারদ সংখ্যার সূচনা হয়েছিল, তা বলা কঠিন। প্রাবন্ধিক এবং সাহিত্যসমালোচক অরুণ মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন বই-পত্রের তথ্যাদির সাহায্যে তাঁর ‘বাংলার শারদ সাহিত্য’ (শারদীয় কথাসাহিত্য ১৪১৫) প্রবন্ধে শারদ সাহিত্যের সূচনার কিছু পরিচয় দিয়েছেন। তাতে দেখা যায়, বাংলায় কেশবচন্দ্র সেন সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সুলত-সমাচার’-এর ১২৮০-এর ১০ আশ্বিনে ‘ছুটির সুলভ’ নামে বিশেষ সংখ্যা থেকে শারদ সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল। এভাবে মনোমোহন বসু সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকার ১২৮০-এর ২ কার্তিক সংখ্যায় দুর্গাবন্দনা, দুর্গোৎসবের বর্ণনা ও উৎসবের রূপ এবং অব্যবহিত পরের সপ্তাহে ‘দুর্গোৎসব’ নামে একটি কবিতা প্রকাশের কথা জানা যায়। কিন্তু এভাবে অনুমিত কথায় তথ্যের মধ্যে প্রচলিত শারদ সাহিত্যের পরিচয় মেলে না। কেননা প্রথমত তখনও অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে শারদ সাহিত্যের স্বতন্ত্র ধারা গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, শারদ সাহিত্যের সঙ্গে দেবী দুর্গার সাময়িক যোগ ছাড়া আক্ষরিক যোগ কতটা রয়েছে সেবিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। তাছাড়া ছুটির অবসরের নিমিত্ত সাহিত্যকে তো আর শারদ সাহিত্যের সোপানে তুলে ধরা সমীচীন নয়। মোটকথা শারদ সাহিত্যের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে। ১৩১৭-এর ভাদ্র সংখ্যাতে ‘যমুনা’ পত্রিকার বিজ্ঞাপনে সরাসরি শারদীয় সংখ্যার কথা জানানো হয়েছে: ‘আগামী আশ্বিন মাস হইতে জাহ্নবীর ভূতপূর্ব সম্পাদক শ্রীযুক্ত নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত ধীরেন্দ্রবাবুর সহিত একযোগে যমুনা সম্পাদন করিবেন। বঙ্গের যাবতীয় প্রথিতনামা লেখক ও লেখিকাগণের প্রবন্ধ-গৌরবে যমুনার অপূর্ব সৌন্দর্যবৃদ্ধি হইবে। শারদীয় সংখ্যা যমুনার জন্য আমরা কিরূপ সুন্দর ও সর্বজনপ্রীতিকর প্রবন্ধরাজির আয়োজন করিয়াছি… আশ্বিন সংখ্যা প্রাপ্ত মাত্রেই তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন।’ ফলে সহজেই অনুমেয় উক্ত সংখ্যায় শারণীয় সাহিত্যের আমদানি হয়েছিল। সেইসঙ্গে এও লক্ষণীয়, শারদ সাহিত্যে পূর্বের প্রবন্ধের প্রাধান্য আজ আর নেই।
যাইহোক, ‘যমুনা’র পরে সেভাবে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার ১৩২০-এর কার্তিক মাসের আকারে বড়’ সংখ্যাটি ‘পূজা সংখ্যার কাছাকাছি’কে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। এভাবে মাসিক ‘বঙ্গবাণী’র ১৩২৯-এর আশ্বিন সংখ্যা, কিংবা ‘ভারতী’র ১৩৩৩-এর আশ্বিন সংখা মাসিক ‘বসুমতী’র ১৯২৫-এর বার্ষিক সংখ্যায় (প্রচ্ছদে ‘শারদীয়া’ শব্দটি থাকত) শারদ সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র শারদ সংখ্যা বিশেষভাবে স্মরণীয়। কেননা এই পত্রিকার প্রথম বছরের শারদ সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহের আগুন ঝরে পড়ায় তাঁর কারাবাস সুনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। ১৯২২-এর ২৬ সেপ্টেম্বরে পূজা সংখ্যায় হৃদয়াগ্নি জ্বালানো কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয় : ‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাড়াল।/ দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ ভূ-ভারত আজ কসাইখানা….আসবি কখন সর্বনাশী?’ এরূপ অগ্নিস্রাবী কবিতার জন্য নজরুলের ভাগ্যে গ্রেফতারি জারি হওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। হলও তাই। পুলিশ কুমিল্লা থেকে নজরুলকে ১৯২২-এর ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার করে। শুধু তাই নয়, এজন্য ‘ধূমকেতু’ ও ‘ধূমকেতু’র মতো হারিয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৯২৫-এ সম্পাদিত ‘পার্বণী’র মধ্যে শারদ সংখ্যার ছাপ স্পষ্ট। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নিবেদনে জানানো হয় : ‘বাংলাদেশে এই ধরনের কোনও বই নাই, ইহার অভাব পূরণ করিবার উদ্দেশ্যেই ‘পার্বণী’ নাম দিয়া সর্বপ্রথম এই নতুন ধরনের একখানি বই প্রকাশিত হইল।’
আবার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সূচনা বছর (১৯২২) থেকেই শারদ সাহিত্যের প্রয়াস লক্ষণীয়। ১৩৩৩-এ (১৯২৬) এই পত্রিকার স্বতন্ত্র শারদ সংখ্যার কথা জানা যায়। যাইহোক, তবে শারদ সাহিত্য সাড়া ফেলেছিল গত শতাব্দীর চতুর্থ দশকের মাঝামাঝিতে। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাময়িক পত্রিকা ‘দেশ’-এ শারদ সংখ্যা স্বতন্ত্রভাবে বেরিয়েছিল ১৯৪৩ সাল থেকে।
ওই বছর পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলার জনজীবন সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘পূজার আয়োজন’-এ জানানো হয়েছে সমগ্র বাঙলা দেশের আজ সর্বনাশ হইতে বসিয়াছে। ক্ষুধার অন্ন দিয়া বাংলার গ্রাম অঞ্চলগুলি যদি এখনও রক্ষা করিবার ব্যবস্থা না হয়, তবে বাঙলা দেশ যে শ্মশানে পরিণত হইবে, এ সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাই ভাবিতেছি, বাঙালী আজ কাহার পূজা করিবে?… অকাল বোধনের কথা মুখেই শুনিয়াছি, আজ বাঙলা দেশে সত্যই অকাল বোধনের সময় আসিয়াছে।…’ অথচ সেই ‘অকাল বোধনের সময়’-এও বাংলার পাঠকমহলে শারদ সাহিত্যের আমদানি হয়েছিল। আসলে ভাববিলাসী বাঙালির মনে যে আমুদে রসিক প্রকৃতি রয়েছে, তার জোরেই বাঙালিরা প্রতিবছর বানভাসি জীবনেও শারদীয়া দুর্গাপুজোয় মেতে উঠতে পারে। সেজন্য শারদ সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। তবে এই শারদ সাহিত্যের বৈচিত্রা বাড়েনি, বরং একই আছে। গড়পড়তা সেই কোনো প্রতিষ্ঠিত লেখকের মৃত্যুর পরে অপ্রকাশিত রচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক প্রায় সবই তাতে মজুত থাকে। এমনকি পত্রিকাগুলোর শারদ সংখ্যায় চরিত্রগত স্বাতন্ত্র্যও বিশেষ থাকে না। তবে লিটল ম্যাগাজিনগুলো অনেক সময় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সকলেরই লক্ষ্য থাকে বরণীয় লেখকের স্মরণীয় সম্ভারকে উপস্থিত করা। সেজন্য পুজো সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করায় সকল সম্পাদকই তৎপর হয়ে থাকেন। যারফলে বছরের অন্যান্য সংখ্যার চেয়ে শারদ সংখ্যাগুলো অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়। লেখকরাও তাঁদের সেরা লেখাটিকে পুজো সংখ্যার জন্য তুলে রাখে। মোটকথা পত্রপত্রিকায় শারদ সংখ্যা প্রকাশের একপ্রকার ধুম পড়ে যায়।
বাণিজ্যিকভাবে শারদ সংখ্যা প্রকাশে লেখক ও প্রকাশকের উভয়েরই লাভ। লেখকের যেমন নগদ লক্ষ্মী প্রাপ্তির সুযোগ ঘটে, তেমনই তাঁর লেখার মূল্যায়নেরও সুযোগ বাড়ে। অন্যদিকে প্রকাশকের আর্থিক আয় আরও বাড়ে। কিন্তু শারদ সাহিত্যের বিপুল আয়োজনে সাহিত্যের গুণগত উৎকর্ষ কতটা হয়, সে বিষয়ে আলোচনার অবকাশ থেকেই যায়। প্রথম দিকের শারদ সাহিত্যের গুণগত মান অনেকটাই উঁচুতে ছিল। বিশিষ্ট সমালোচক নারায়ণ চৌধুরী ‘দেশ’-এ (১৭ নভেম্বর ১৯৫১) তাঁর ‘শারদীয় সংখ্যার ছোটগল্প’ প্রবন্ধে জানিয়েছেন গত পনেরো বৎসরের শারদীয় সংখ্যাগুলির যদি একটা হিসাব নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, লেখকদের অধিকাংশ প্রতিনিধিত্বমূলক ছোটগল্প—যেসব গল্পের জন্য তাঁদের প্রতিষ্ঠা দৃঢ়তর হয়েছে—এই বিশেষ সংখ্যাগুলিতেই বেরিয়েছে।’ ‘দেশ’ পত্রিকার সুবিখ্যাত সম্পাদক সাগরময় ঘোষও তাই মনে করতেন। কিন্তু আগের তুলনায় এখনকার শারদ সাহিত্যের সম্ভার অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেই ধারা অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। এজন্য একালের স্বনামখ্যাত কথাসাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত তাঁর ১৩৯৫-এ লেখা ‘পুজো সংখ্যা’ প্রবন্ধে (‘সঙ্গ ও প্রসঙ্গ’) নিজেকে ‘পুজো সংখ্যার পক্ষে’ বলা সত্বেও একালের পত্র-পত্রিকার শারদ সাহিত্য সম্পর্কে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছেন। উপন্যাসসর্বস্ব শারদ সংখ্যা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন সাধারণো প্রচলিত ধারণার ব্যতিক্রম নয়। তাঁর কথায় : ‘দুটি বা তিনটি অনতিখ্যাত, ছোট মাঝারি পত্রিকা বাদ দিলে, বিশেষত বড়ো পুঁজির সাত-আটটি পত্রিকার পুজো সংখ্যা ঘাঁটলে যে অস্বস্তিকর ব্যাপারটি প্রথমেই চোখে পড়ে তা হলো এঁদের উপন্যাস বা উপন্যাসধর্মী কাহিনী প্রকাশের দিকে অস্বাভাবিক ঝোঁক। এবার এরই মধ্যে যেসব পুজো সংখ্যা হাতে এসেছে, সেগুলির পাতা উল্টে এবং গুণে বিভিন্নতা এইরকম উপন্যাস ও বড়ো গল্প : ৭২%, গল্প ১০%, ভ্রমণ, স্মৃতিকথা, রম্যরচনা: ১০%, পাঁচমিশেলি প্রবন্ধ: ৬% এবং কবিতা: ২%। এর মধ্যে প্রথম তিন শ্রেণীর রচনাকে একই শ্রেণীতে, একই ধরণের পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্যে প্রকাশিত হয়েছে ধরে নিলে শতাংশের সম্মিলিত হিসেব দাঁড়ায়: ৯২%।’ এজন্য দিব্যেন্দু পালিতের মতে, ‘পুজো সংখ্যা’গুলি তাই ‘উপন্যাস সংখ্যা’য় পরিণত হয়েছে। তিনি নিজে কথাসাহিত্যিক হয়েও এই প্রবণতাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। কেননা তাতে তাঁর মতে :’ …এই প্রবণতা বাঙালির মননশীলতার প্রতি একধরনের অবজ্ঞাই সুচিত করে। উৎকৃষ্ট প্রবন্ধের অভাব দেখে ধরে নিতে হয়, শিল্পকলা, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, চলচ্চিত্র, নাটক এবং এমনকি সাহিত্য বিষয়ক রচনা পাঠে বাঙালির আগ্রহ আন্তর্হিত হয়েছে।’ এপ্রসঙ্গে স্মরণীয়, প্রথম দিকের শারদ সাহিত্যে প্রবন্ধাদির প্রাধান্য ছিল। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ্য, দিব্যেন্দু পালিতের অনেক পূর্বেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তাঁর ‘সনাতন পাঠকের চিন্তা’য় পত্রপত্রিকার শারদ সংখ্যায় উপন্যাসাদির আধিক্য সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন।
অন্যদিকে, উপন্যাসও প্রকাশিত হত, কিন্তু তার সংখ্যা এখনকার মতো একাধিক ছিল না। কিন্তু একাধিক উপন্যাস প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ১৯৬০-এর পরে। আর তার যাত্রা শুরু হয়েছিল সিনেমা পত্রিকা ‘উল্টোরথ’-এর মাধ্যমে। তারপর তা ছোঁয়াচে রোগের মতো সাফল্য অর্জন করেছে। বাণিজ্য পত্রিকা মানেই যেন উপন্যাস প্রকাশের স্থূল পত্রিকা। কেননা সাহিত্যিক শঙ্করের ভাষায়, ‘একজন লেখকের ওপর নির্ভর করা নিরাপদ নয়, সেই চিন্তা থেকে পলিসির পরিবর্তন এল।’ শুধু তাই নয়, এখনকার শারদ সাহিত্যের ভুরিভোজে একজন ঔপন্যাসিককে একাধিক পত্রিকাতেই নয়, একাধিক নামেও উপন্যাসের রসদ যোগাতে হয়। তার উপর গুণমান বজায় রাখার দায় থেকে অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকার পুরোনো লেখা দিয়ে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। যে কারণে ‘কথাসাহিত্য’, ‘কলেজস্ট্রীট’, ‘এক্ষণ’-এর মতো উল্লেখযোগ্য পত্রিকার শারদ সংখ্যাকে সাজাতে হয়েছে পুনর্মুদ্রণ দিয়ে। তাছাড়া শিশু-কিশোরদের শারদ সাহিত্যের কথা না তোলাই শ্রেয়। বড়দের অজস্র শারদ সংখ্যার পাশে তাদের জন্য হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকার আধিপত্য (তাও আবার অনেকক্ষেত্রে পুরনো লেখা দিয়ে সাজানো) বড়ই বেদনাদায়ক। সেইসঙ্গে একই লেখককে অসংখ্য পত্রিকায় লিখতে হয়। ফলে তাঁর লেখার মধ্যে বৈচিত্র এলেও ভাবের নিষ্ঠায় অভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। এজন্য সুবিপুল শারদ সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছে, নাকি গুণগত মানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, এ বিষয়ে আপনাতেই বিতর্কের অবকাশ তৈরি হয়ে যায়।
অনেকের ধারণা শারদ সাহিত্য শারদীয় দুর্গোৎসবের মতো অকালে হাজির হয়েও জনসমাদর লাভ করেছে। কিন্তু এ ধারণা অমূলক। সংস্কৃতে ‘শরৎ’ শব্দে দুটি অর্থ বোঝানো হত। একটি ঋতুবিশেষ এবং অন্যটি বছর। আর্যরা শীত ঋতুর পাশাপাশি শরৎ ঋতুর শুরু থেকে আর এক বছর হিসাব করতেন। সেদিক থেকে শরতে নববর্ষ শুরু হয়। বিশিষ্ট মনীষী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি দুর্গাপুজোর সময়কে অকাল না বলে নববর্ষ বলে অভিহিত করেছেন (‘দুর্গাপূজার তাৎপর্য, শনিবারের চিঠি’, পৌষ ১৩৬২)। সেদিক থেকে শারদ সাহিত্যও নববর্ষের ফসল। আবার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (শারদ) শব্দের একটি অর্থ অভিনব বলে জানিয়েছেন। ফলে শারদ সাহিত্য অভিনব সাহিত্যও বটে। কিন্তু শারদ সাহিত্যের অভিনবত্ব কতখানি সে বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অসংখ্য রচনার ভিড়ে সৃষ্টি কতটা অভিনবত্ব লাভ করে, তা মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। শুধুমাত্র খাতা ভরানোর জন্য লেখার কোনো সার্থকতা নেই। তাই পাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করে শারদ সংখ্যাকে যুৎসই মেদবহুল আকৃতি দিয়ে অভিনব সাহিত্যের আমদানি সম্ভব নয়। সেজন্য চাই আত্মবিশ্লেষণ তথা আত্মসমীক্ষা। তা নাহলে দেবী দুর্গার প্রচ্ছদ নিয়ে শারদ সংখ্যা বের হলেও তাতে শারদ সাহিত্য সৃষ্টি হবে না।
যে শারদ সাহিত্য বাঙালির অভ্যাসে ছিল, এখন তা ব্যাধিতে দাঁড়িয়েছে। তার ফলে তার নানারকম বিকার এসে দেখা দিয়েছে। দেবীর অকালবোধন না বুঝতে পারলেও শারদ সাহিত্যের অকালে আবির্ভাব সহজেই চোখে পড়ে। মায়ের বোধনের অনেক আগেই শারদ সাহিত্যের বোধন হয়। বাণিজ্যিক পত্রিকায় ‘মা আসছে বলে’-ই তার সঙ্গে শারদ সংখ্যার আগমন বার্তা বিঘোষিত হয় এবং মা’র আসার আগেই সন্তান তার পসরা সাজিয়ে বসে। ব্যবসায়িক ছাপ তার সর্বত্র। ফলে সেক্ষেত্রে লেখার চেয়ে লেখকের দর বেশি, পণ্যের চেয়ে বিপণনে বেশি মন। কে আগে বাজার দখল করবে এই যার লক্ষ্য হয়ে ওঠে, সেখানে শারদ সাহিত্যের অভিনব আস্বাদ প্রত্যাশিত নয়। আর লিটল ম্যাগাজিনও সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে কুলিয়ে উঠতে পারে না। অথচ বাণিজ্যিক পত্রিকার আদলে শারদ সংখ্যা প্রকাশ করা চাই। ফলে শারদ সংখ্যায় কতটা শারদ সাহিত্য উঠে আসে সে বিষয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। আগে পুজো সংখ্যায় নতুনদের একটা জায়গা থাকত। এখন ছোট-বড় প্রায় সব বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় আমন্ত্রিত বরণীয় লেখকদের স্মরণীয় লেখা’র সমাহার। অথচ বাণিজ্যসফল ‘আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯৩৮-এর ২০ আগস্টে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছিল, ‘যাঁহারা এই সংখ্যায় (পূজা) লিখিতে চাহেন, তাঁহারা অনুগ্রহপূর্বক নিম্ন ঠিকানায় তাহাদের রচনা পাঠাইবেন।’ এখন তা ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। তার পরেও অনেক সময় শারদ সংখ্যায় নতুন লেখক উঠে আসে ঠিকই, কিন্তু নতুন ধরনের সাহিত্য সচরাচর লক্ষ্য করা যায় না। অথচ তাই হতে পারতো আমাদের সেরা শারদ সাহিত্য উপহার। বাংলা সাহিত্যে যথার্থভাবে যিনি প্রথম শারদ সাহিত্যের আস্বাদ দিয়েছিলেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দুর্গাই শারদ সাহিত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানবী মূর্তি। অথচ বিভূতিভূষণের সেই শারদ সাহিত্য কোনো শারদ সংখ্যায় বেরোয়নি, বেরিয়েছিল বই আকারে মহালয়ার দিন ১৩৩৬-এর ১৬ আশ্বিন (১৯২৯-এর ২ অক্টোবর)। সেকথা আমরা ভুলে যেতে বসেছি।