৫০০ বছরের দেবী উত্তরবাহিনী যিনি পাণ্ডিত্যের প্রতীক

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

কুমারেশ চক্রবর্তী

বিখ্যাত পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় তর্ক পঞ্চাননের পৌত্র রাজেন্দ্রনাথ শিক্ষায় মোটেই আগ্রহী নয়। তার কোন বিদ্যা নেই, বুদ্ধি নেই। তাই দিনরাত পিতার কাছে নিন্দিত হন। লোক কাহিনী অনুসারে,একদিন পিতার আদেশে মা তার পাতে খাবারের সঙ্গে ছাই দিলেন। বাবা মনে করেছিলেন এতে যদি পুত্রের বোধোদয় হয়। কিন্তু এর ফলে অপমানিত পুত্র কাছেই কৌশিকী নদীতে আত্মবিসর্জন করার জন্য জলে ঝাঁপ দিলেন। তার মৃত্যু হলো না, হাতে ঠেকলো একটি পাথর। সে যেন দৈববাণী করলেন, তুমি আমাকে তুলে নিয়ে প্রতিষ্ঠা কর, তাহলেই তোমার মনের দুঃখ দূর হবে, বিদ্যা বুদ্ধি পাণ্ডিত্য তুমি সব পাবে, তোমার অর্থাভাবও থাকবে না। সেই যুবক জল থেকে উঠে কাছেই প্রতিষ্ঠা করলেন দেবীকে। কিন্তু তার তো কোনো আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাই গাছের ডাল পালা পাতা দিয়ে একটা ছোট্ট কুঠি তৈরি করে সেখানেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং নিজেও থাকতে শুরু করলেন তার তো চিনি বাতাসা কেনার সামর্থ্য নেই। তাই জঙ্গলের ফলমূল বেলপাতা দিয়েই দেবীর সেবা করলেন এবং নিজেও ওই ফলমূল খেয়েই থাকতে লাগলেন। ক্রমে এই বার্তা রটে গেল গ্রামে গ্রামান্তরে। গ্রামের মানুষের চেষ্টায় সেখানেই গড়ে উঠলো আটচালা চণ্ডীমন্ডপ।পূজিত হতে লাগলেন দেবী। দেবীর আশীর্বাদে ধীরে ধীরে রাজেন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন মহা পন্ডিত, পন্ডিত সার্বভৌম।

অলৌকিক হলেও সত্য অচিরেই সেই যুবক হয়ে উঠলেন বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞানে পন্ডিত সার্বভৌম। এই ভাবেই মা দুর্গার এক ভিন্ন রূপ ভেবে উত্তরবাহিনীর প্রতিষ্ঠা, শরতকালের শুক্লা একাদশীতে। আসলে শরৎকালে বাংলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামাঞ্চলে মা দুর্গা ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন অঞ্চলে পূজিত হন, এদের বলা হয় লৌকিক দেবতা। লৌকিক দেবতার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, তিনি স্থানীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধভাবে পূজিত হয়ে থাকেন এবং তার মূর্তি অন্য কোথাও দেখা যায় না। তাছাড়া পূজার প্রতিষ্ঠা বা প্রচলনকে কেন্দ্র করে একটা লোক কাহিনী প্রচারিত এবং সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। হুগলি জেলার শিয়াখালায় (আদি নাম শিব ক্ষেত্র) তেমনি এক অত্যন্ত জনপ্রিয় লৌকিক দেবী হলেন উত্তরবাহিনী, যাকে কেউ বলেন চান্ডি বা চন্ডী কেউ বলেন বিশালাক্ষী। কিন্তু নামে মতভেদ থাকলেও শাস্ত্র অনুসারে পূজা পদ্ধতি প্রায় একই হয়ে থাকে। তবে শিয়াখালার দেবী উত্তরবাহিনীর যে মূর্তির অনুরূপ আরো একটি মূর্তি দেখা যায় শিয়াখালা থেকে কিছুটা দূরে হুগলি জেলারই রাজবল্লভহাটে, যিনি রাজবল্লভী দেবী নামে পরিচিত।


শিয়াখালার উত্তরবাহিনী দেবীর প্রাচীনত্ব,প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা অপরিসীম। এর প্রমাণ আমরা মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যেও পেয়ে থাকি।রূপরামের ধর্মমঙ্গলে এর উল্লেখ দেখা যায়। সেখানে রূপরাম লিখছেন,
“শ্মশানে বন্দিলাম শ্যামা করালবদনী সেইখালায় বন্দিলাম উত্তবাহিনী।”

কথিত আছে দেবী উত্তরবাহিনী আগে ছিলেন দক্ষিণমুখী। কেন তিনি উত্তরমুখী হলেন তা নিয়ে স্থানীয় অঞ্চলে একটি লোক কাহিনী প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক সুবোধ ঘোষ তাঁর সুপরিচিত “কিংবদন্তির দেশে” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন একটি কাহিনী। তার কাহিনীর মূল কথা হলো, এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত যুবক তার টোল খোলার জন্য স্থানীয় ভৌমিক জমিদারের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন। ওই জমিদার ছিলেন অত্যন্ত দাম্ভিক এবং অত্যাচারী, তিনি ওই ব্রাহ্মণ যুবককে কোন সাহায্য না করে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই যুবকই স্থানীয় কৌশিকী নদীতে আত্মহত্যা করতে গিয়ে দেবী উত্তরবাহিনী কে পান। সুবোধ ঘোষ আরো বলেছেন, একবার ওই উত্তরবাহিনী মন্দিরের সামনে কৌশিকী নদীতে ভৌমিক জমিদারের বজরা করে নাচ গান করতে করতে যাচ্ছিল। দেবী বালিকার বেশ ধরে তাকে নৌকো থামাতে বলেন, গান শোনার জন্য। কিন্তু দাম্ভিক জমিদার তাঁর কথা না শুনে চলে যায়। সেই মুহূর্তেই কুপিত দেবী মুখ ঘুরিয়ে উত্তরমুখী হলেন। সঙ্গে সঙ্গে নদীর গতি উত্তরমুখী হয়ে গেল। হঠাৎ স্রোতের এই পরিবর্তনে জমিদার তার দলবল সহ নৌকাডুবিতে মারা গেলেন। সেই থেকেই দেবী উত্তরমুখী হয়ে আছেন। তার থেকেই উত্তরবাহিনী নাম।

উত্তরবাহিনী দেবীর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আরেকটি ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় গোপেন্দ্র কৃষ্ণ বসু রচিত “বাংলার লৌকিক দেবতা” গ্রন্থে, জানা যায়, খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে শিয়াখালা অঞ্চল ছিল গভীর অরণ্যে ঢাকা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা আদিবাসীদের বাস। সেই সময় বাংলায় রাজত্ব করতেন হোসেন শা। তিনি কিছুতেই এদের বাগে আনতে পারছিলেন না। এরা বারবার সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল। তখন তিনি তার উজির (পুরন্দর খাঁ ) গোপীনাথ বসুকে বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব দিলেন। পুরন্দর খাঁ নামকরা কবি হলেও যুদ্ধবিদ্যায় ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও পারদর্শী। তিনি ওই অরণ্যবাসীদের পরাজিত করে সমগ্র অঞ্চল সুলতানের দখলে আনলেন। সুলতান হোসেন শা পুরন্দর খা কে জায়গীর স্বরূপ সমগ্র শিয়াখালা দান করলেন। পুরন্দর সেখানে তার প্রাসাদ নির্মাণ করলেন এবং তিনি উত্তর বাহিনী দেবীর পাকা মন্দির নির্মাণ করে দিলেন। যদিও এই মন্দির বাংলার বা ভারতের অন্যান্য দেবদেবীর মন্দিরের মতো চূড়াযুক্ত নয়। সাধারণ বাড়ির মতোই নাট মন্দির সহ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। যদিও তার পরবর্তীকালে শত শত বছরে বহু পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু মূল কাঠামোটি প্রায় একই থেকে গেছে।

উত্তরবাহিনী দেবী মূর্তি একেবারেই বিরল। শুধু বাংলা নয় সারা ভারতবর্ষে এমন মূর্তি কোথাও দেখা যায় না (কাছাকাছি রাজবল্লভী ছাড়া)! প্রায় সাত ফুট লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা গায়ের রং রক্ত হরিদ্রা, এলোকেশ তার ওপর মুকুট। উত্তরবাহিনী দ্বিভূজা, ত্রিনয়নী, নাকে নথ,গলায় মুন্ডমালা এবং নানা ধরনের হার। ডান হাতে খরগো, বামে রুধির পাত্র। পরনে বক্ষবন্ধনি এবং বিচিত্র বর্ণের গাড়া জাতীয় শাড়ি যা কোমর থেকে পা পর্যন্ত বিস্তৃত, অনেকটা হিন্দুস্তানি মেয়েদের মত অলঙ্কার,চুরি ,মল প্রভৃতি।দেবীর ডান পা নীচে শায়িত মহাকাল রূপী শিবের বুকের উপর, বাম পা টি পায়ের কাছে জোর হাতে বসে থাকা নীল বর্ণের বটুক ভৈরবের মাথায়।

শত শত বছরে উত্তর বাহিনী দেবীর মূর্তি তেমন কোনও পরিবর্তন না হলেও তাঁর হাতের অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিসের পরিবর্তন হয়ে গেছে, যেমন আগে হাতে ছিল তলোয়ার এখন হয়েছে খড়গো। আগে ছিল হাতে মুণ্ডু পরে হয়েছে রক্তের পাত্র। কথিত আছে, উত্তরবাহিনী মূর্তি প্রথম দিকে পৃথকভাবে তৈরি করা হয়নি, যে পাথরের মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল সেটাকেই পূজা করা হতো। সেটি ছিল একটা ছোট কালো পাথরের গায়ে খোদাই করা ৮/১০ ইঞ্চি উচ্চতা বলেই শোনা গেছে। এই পাথরেই শতাধিক বছর ধরে পুজো হয়েছে । তার অনেক পরে স্থানীয় শিল্পীরা একটি মাটির মূর্তি তৈরি করেছিলেন। তারও শখানেক বছর পরে কৃষ্ণনগর থেকে শিল্পী আনিয়ে নতুন করে সুদৃশ্য মাটির মূর্তি তৈরি করা হয়। অবশেষে শতাধিক বছর আগে কাশীর শিল্পী দ্বারা বর্তমান প্রস্তর নির্মিত মূর্তিটি তৈরি করা হয়। এর উচ্চতা প্রায় ৭ ফুট। তবে মাটির মূর্তি গুলির উচ্চতা এত বড় ছিল না। এই নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ১৩৪০ সনের ১৬ই আষাঢ়, স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্যেই এই কার্যসম্পন্ন হয়েছিল। তাই ১৬ই আষাঢ় দেবীর বার্ষিক উৎসব পালন করা হয়।

উত্তরবাহিনী দেবীর মূল উৎসব হয় প্রতিবছর আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে অর্থাৎ দূর্গা পূজার বিজয়ার পরের দিন। এই উৎসবকে বলা হয় “জাত” উৎসব। জাত বলতে এখানে দেবীর জন্মের কথাই বলা হয়েছে। এই দিনে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত পুরনো ঘট বিসর্জন দিয়ে নতুন ঘট স্থাপন করা হয়।

এই কাজটি সুসম্পন্ন করা হয় প্রাচীন প্রথা অনুসারে রাজেন্দ্রনাথ বংশীয় শান্ডিল্য গোত্রীয় ভট্ট নারায়ণ বংশধরদের দ্বারা। আজও ওই বংশের একজন সদস্য এই ঘট পরিবর্তনের শুভ কাজটি করে থাকেন, প্রায় ৪০০ বছরের অধিক এই প্রথা চলে আসছে। বছরে চার পাঁচটি বড় উৎসব এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। যেমন বৈশাখ মাসে হয় সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য দেশ মালা উৎসব। ১৬ই আষাঢ় হয় প্রস্তর নির্মিত মূর্তিটির প্রতিষ্ঠা দিবস বা বার্ষিক উৎসব। আর মূল অনুষ্ঠান হয় শরৎকালের শুক্লপক্ষে একাদশীতে।

উত্তরবাহিনী দেবী স্থানীয় লৌকিক দেবতা হলেও এর জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব হুগলি সহ আশেপাশের জেলাগুলিতে বিস্তারিত হয়েছে। বিজয়া দশমীর পরের দিন অর্থাৎ শরতের শুক্লা একাদশীতে উত্তর বাহিনী দেবীর ঘট পরিবর্তন হয়। প্রতিষ্ঠাতা বংশের বংশধররাই প্রাচীন প্রথা অনুসারে এই ঘট পরিবর্তনের কাজটি করে থাকেন। তবে মূল পূজা একদিনের হলেও সারা বছরই এর পূজা হয়ে থাকে। এই একাদশীতে পূজার দিনে স্থানীয় অঞ্চলে জাতীয় উৎসবের চেহারা নেয়। মেলা এবং পালা গান যাত্রা নাটক প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়, আগে হতো রাম যাত্রা। অন্যান্য বিষয় নিয়ে স্থানীয় এলাকা জমজমাট হয়ে থাকে, দূর দুরান্ত থেকে ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। তবে উত্তরবাহিনী দেবীর প্রত্যেকটি উৎসবেই গ্রামের মেলা এখানকার অপরিহার্য অঙ্গ।

স্থানীয় বিশিষ্ট শিক্ষক উত্তরবাহিনী প্রতিষ্ঠাতাদের বংশধর প্রবীর ব্যানার্জি জানালেন যে, এই পূজার সঙ্গে জাঁকজমক অপেক্ষা স্থানীয় মানুষের আবেগ, অনুভূতি অনেক গভীরভাবে জড়িত। প্রবীরবাবুর কাছ থেকেই আমি প্রথম উত্তরবাহিনী দেবীর কাহিনী শুনি। বর্তমানে পুজো এবং মন্দির একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত কমিটির দ্বারা পরিচালিত হয়। বর্তমানে এর সম্পাদক হচ্ছেন প্রতিষ্ঠাতা বংশেরই এক সদস্য অরুময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সভাপতি অমরুত লাল প্যাটেল। অরুময় বাবু জানালেন, বর্তমানে আমরা কিছু কিছু সমাজসেবামূলক কাজ শুরু করেছি, যেমন গত কয়েক বছর ধরে বিনামূল্যে চিকিৎসা, বস্ত্র বিতরণ, প্রতিদিন প্রায় শখানেক মানুষকে ভোগ প্রসাদ বিতরণ প্রভৃতি।

তবে জাঁকজমক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড সীমিত হলেও শত শত বছর ধরে প্রাচীন ঐতিহ্যকে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে বহন করে নিয়ে যাওয়াটাই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে প্রশংসীয় ও চমকপদ ব্যাপার। যা বর্তমানে একান্তই বিরল।