‘হাবিজাবি’-র পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন ভিন্নধারার লেখক সুবিমল বসাক

ফাইল চিত্র

গৌতম মণ্ডল

৮৬ বছর বয়সে চলে গেলেন ভিন্নধারার অন্যতম ব্যতিক্রমী লেখক সুবিমল বসাক। ভিন্ন গদ্যরীতিতে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ লিখলেও সারস্বত সমাজে তিনি যথাযথ মর্যাদা পেয়েছেন বলে মনে হয় না।
সুবিমল বসাক জন্মগ্রহণ করেন ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সালে, বিহারের পাটনায়। অবশ্য তাঁর পৈতৃক বাস ছিল পূর্ববঙ্গের ঢাকায়। বাবা যৌবনে ওপারবাংলা ছেড়ে চলে আসেন ভারতে, বিভিন্ন জায়গায় কাজের সন্ধান করতে করতে থিতু হন পাটনায়। সোনার দক্ষ কারিগর ছিলেন। ছিলেন উদ্যমী ও পরিশ্রমী, এইকারণে কিছুদিনের মধ্যেই পাটনায় নিজস্ব দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন।

তবে প্রায় সমস্ত আত্মীয়স্বজন ঢাকায় থাকায় ১৯৪৯ সাল নাগাদ তাঁরা সপরিবারে ঢাকায় চলে যান। কিন্তু পঞ্চাশের প্রাণঘাতী দাঙ্গায় আত্মীয়স্বজনসহ তাঁরা সকলেই স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ফেলে আবার চলে আসেন ভারতে। কিন্তু ফিরে এসে আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন এবং সুবিমলের বাবা আত্মহত্যা করেন।


ছোটবেলা থেকেই গতানুগতিকতার বাইরে ভাবতে ভালোবাসতেন সুবিমল। এই সূত্রেই ১৯৬৩ নাগাদ পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়ের নেতৃত্বে যোগদান করেন হাংরি আন্দোলনে। স্বতন্ত্র গদ্যভাষার কারণে তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্রমশ আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। কিন্তু অজ্ঞাতকুলশীল এই লেখকের জনপ্রিয়তা তৎকালীন সময়ের অনেক সম্ভ্রান্তবংশীয় লেখকেরা খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। এইসময় নিজের চিন্তাধারা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার জন্য তিনি একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করার সিদ্ধান্ত নেন। অচিরেই প্রকাশিত হয় সুবিমল বসাক সম্পাদিত খানিকটা ভিন্ন ঘরানার লিটল ম্যাগাজিন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। এই পত্রিকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু-সহ হাংরি লেখকেরা প্রায় সকলেই লিখতেন। অশ্লীলতার দায়ে হাংরি জেনারেশনের যে এগারোজন লেখকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল, বলা‌ বাহুল্য, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

সুবিমল বসাকের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। ‘ছাতামাথা’। এই গ্রন্থটি পুরোটাই ঢাকাইয়া কথ্য বাংলায় লেখা। প্রথানুগ রীতি অনুযায়ী পরপর ঘটনার বিবরণ নেই এতে। এজন্য এই গ্রন্থের টেক্সটকে ডিন্যারেটিভাইজড উপন্যাস হিসেবে কেউ কেউ চিহ্নিত করেন। হাংরি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা মলয় রায়চৌধুরীর মতানুসারে, ‘ছাতামাথা’ই হল বাংলা ভাষার প্রথম ‘ডিন্যারেটিভাইজড উপন্যাস’। তাঁর অন্যান্য গদ্যগ্রন্থগুলোর তালিকা যথাক্রমে ‘গেরিলা আক্রোশ’ (১৯৭৪), ‘আত্মার শান্তি দু’মিনিট’ (১৯৮৫), ‘অযথা খিটক্যাল’ (১৯৮৭), ‘কুসংস্কার ১৫৫’ (১৯৮৭), ‘প্রত্নবীজ’ (১৯৯৬), ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ (২০০০), ‘এথি’ (২০০১), ‘কুট্টি’ (২০০৩), ‘তিজোরীর ভিতর তিজোরী’ (২০০৫), ‘গোপন দস্তাবেজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আত্মা’ (২০০৭), ‘দুরুক্ষী গলি’ (২০১১), ‘এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি’ (২০১৪) প্রভৃতি।

এগুলোর মধ্যে ‘কুসংস্কার ১৫৫’ বইটি আশ্চর্য ধরনের। লেখক আশপাশে ছড়িয়ে থাকা ১৫৫টি কুসংস্কারকে গ্রন্থিত করেছেন। অপরপক্ষে ‘প্রত্নজীব’, ‘এথি’ এবং ‘তিজোরীর ভিতর তিজোরী’ এই তিনটি বইয়ে এসেছে আবার বিহারীদের বাংলা উচ্চারণ। ‘দুরক্ষী গলি’ আসলে পাটনার একটা ঘিঞ্জি গলি। মুর্শিদাবাদ থেকে উৎখাত হয়ে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে উৎখাত হয়ে স্বর্ণকাররা পাটনার এই গলিতে এসে কোনোরকমে জীবন নির্বাহ করতে থাকেন। এঁদের কথাই অসম্ভব সহমর্মিতায় লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপন্যাসে। এই উপন্যাসটি, কোনো সন্দেহ নেই, সুবিমল বসাকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

এর বাইরে রয়েছে তাঁর দুটি ভিন্ন ধারার কাব্যগ্রন্থ। ‘হাবিজাবি’ (১৯৭০) ও ‘বকবকানি’ (২০০০)। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পুরোটাই ঢাকাইয়া শব্দে লিখিত। আসলে ঢাকা থেকে চলে আসতে বাধ্য হলেও ঢাকার প্রতি ছিল অকৃত্রিম টান। ‘হাবিজাবি’ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি ফাল্গুনী রায়ের অভিমত এইরকম : ‘সুবিমল বসাকের মতই প্যান্ট-শার্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে ছিলেন, বাংলা ভাষার জন্যে নিহত না হয়েও সুবিমল শহীদ হয়েছিলেন বাংলা ভাষার জন্যে– অর্থাৎ মসী অসি অপেক্ষাও শক্তিশালী এই প্রবচনের সূত্র ধরে বলা যায় কলকাতার অ্যাকাডেমিক অধ্যাপক বা আধুনিক কবি কেউ কেউ যারা বাড়িতে মা’র সঙ্গে বাঙাল ভাষায় এবং কলেজে কফিহাউসে খালাসিটোলায় বা বেশ্যার সঙ্গে ক্যালকেশিয়ান ডায়ালেকট-এ কথা বলেন– তাঁরা সুবিমলের ভাষারীতিকে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন– কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদরা যেমন একই সঙ্গে শ্রদ্ধেয় সেইমতো সুবিমল বসাকও শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকদের উপহাস গালাগালের গ্লোরীকে ম্লান করে দিয়ে একই ভাষারীতিতে লিখে চলেছেন– লিখে চলবেন।’

আসলে সুবিমল বসাক নিজে একজন সাবঅলটার্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন, বড়ও হয়েছেন দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে, সম্ভবত সেইজন্য তাঁর লেখায় প্রান্তিক মানুষ জীবন্ত হয়ে ওঠে। সুবিমল বসাক সৃষ্ট কোনো প্রান্তিক চরিত্রকেই মনে হয় না বানানো বা আরোপিত।

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় সুবিমল বসাকের গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বিয়ার গীত ও ঢাকাই ছড়া’। এই বইয়ে তৎকালীন ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের গীত যার মধ্যে আচার ও আচরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধরা আছে। শেষদিকে রয়েছে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছড়ার সংগ্রহ। এই বইটির প্রায় পুরোটাই প্রখ্যাত সম্পাদক মীজানুর রহমান পরবর্তীকালে তাঁর পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছিলেন। এই বই থেকে ঢাকার লুপ্ত হয়ে যাওয়া একটি সংস্কৃতির ধারণা পাওয়া সম্ভব।

মৌলিক রচনার পাশাপাশি সুবিমল বসাক নিয়মিত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে অনুবাদ করতেন। অনুবাদক হিসেবেও তিনি বিপুল পরিমাণ কাজ করে বাঙালি পাঠকদের সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর অনুদিত গ্রন্থগুলি হল : ‘প্রতিবেশী জানালা’ (কবিতা সংকলন, ১৯৭৫), ‘তিসরী কসম’ (ফণীশ্বর নাথ রেণু, ১৯৭৬), ‘পঞ্চপরমেশ্বর’ (মূল লেখক– প্রেমচন্দ, গল্পসংকলন, ১৯৮০), ‘ফণীশ্বর নাথ রেণুর শ্রেষ্ঠ গল্প'(১৯৮২), ‘দুই সখী’ (মূল লেখক– প্রেমচন্দ, গল্পসংকলন, ১৯৮৪), ‘জীবনসার’ (মূল লেখক– প্রেমচন্দ, ১৯৮৫), ‘উজ্জয়িনীর রাস্তা’ (মূল লেখক– শ্রীকান্ত বার্মা, কবিতাসংকলন, ১৯৮৬), ‘বোবাদের পল্লীতে’ (মূল লেখক– জগদীশ চতুর্বেদী, কবিতা সংকলন, ১৯৮৯), ‘খুবসুরত’ (মূল লেখক– খাজা আহমদ আব্বাস, গল্পসংকলন, ১৯৯২), ‘গোমুখযাত্রা’ (মূল লেখক– শীলা শর্মা, ভ্রমণকাহিনি, ১৯৯২), ‘মোহন রাকেশ’ (মূল লেখক– প্রতিভা অগ্রবাল, জীবনীগ্রন্থ, ১৯৯৩), ‘হিন্দী কাহিনিসংগ্রহ’ (১৯৯৯), ‘আমার তোমার তার কথা’ (মূল লেখক– যশপাল, উপন্যাস, ২০০১), ‘যাত্রিক’ (মূল লেখক– নীল পদ্মনাভন, ২০০২)।

সুবিমল বসাক প্রখ্যাত লেখক যশপালের হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত উপন্যাস ‘মেরি তেরি উসকি বাত’ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনূদিত গ্রন্থটির জন্য ২০০৭ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন।
বেশ কিছুদিন আগে সুবিমল বসাকের স্ত্রী প্রয়াত হয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে পড়ে গিয়ে তিনি গুরুতর আঘাত পান এবং ভর্তি হন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। আজ সেখানেই হার্ট অ্যাটাকে প্রয়াত হন তিনি।
তাঁর মৃত্যুতে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল, এরকম বলাই যায়।