কলকাতার বিজয় মুকুটে লাগলো যে আরও এক সাফল্যের পালক। এবার যে এই শহর নির্মলেও দেশের অবাক করা দৃষ্টান্তের প্রতীক।
‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে, তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।’
কবিতাটি সেই কবে লিখে গিয়েছিলেন প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ। কবিরা হয়তো এমনই যুগান্ত দ্রষ্টাই হোন। তা না হলে বনলতার অন্তমিলে আবার আসিব ফিরে’র স্বপ্নস্রষ্টা কি করেই বা আগাম জানতে পেয়েছিলেন আজিকার প্রভাতে নব কলকাতার নয়া শ্রেষ্ঠত্বের উজ্জ্বল উপকথা?
হ্যাঁ আজ যে এটাই পূর্ণ সত্য জীবনানন্দের সেই কাব্য সুন্দর তিলোত্তমা নগরীর অধুনা চলমান ইস্তেহারে। কল্লোলিনী কলকাতার মুকুটে আবার শোভিত হলো আরও একটা বিজয় পালক। পরিচ্ছন্নতার অঙ্গনে। পরিবেশের আঙিনায়।
ভারতের সমস্ত মেট্রোপলিটান শহরের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা সবেমাত্র পেল আমাদের গর্বের নন্দিত নগরী ‘সিটি অফ জয়।’
কারণটাও কিন্তু বেশ আভিনব। কলকাতা এই শিরোপাটি দেশের সমস্ত মেট্রোপলিটান শহরের কাছ থেকে ‘ফার্স্ট বয়’ হিসেবে ছিনিয়ে নিয়েছে। পরিবেশ বান্ধব হিসেবে। পরিচ্ছন্ন মিত্র বিচারে।
না না, এটা কোনও কলকাতা প্রেমীর আবেগ ভরা আষাঢ়ে গল্প নয়। এই অবিশ্বাস্য তথ্যটি মঙ্গলবার সুযোগ বুঝে টুক করে প্রথমবারের মতো কলকাতার বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র।
অতি সম্প্রতি কলকাতায় স্থানীয় এক বণিকসভা পরিচালিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কিত এক আলোচনা চক্রের আসর বসে। সেখানেই প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন কল্যাণবাবু। আবহাওয়া ও পরিবেশ বিষয়ক বক্তব্য রাখতে গিয়ে কল্যাণবাবু আচমকা এই তথ্যটি পেশ করে বসেন। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের কাছে একটা আনন্দের সময় কলকাতাবাসী হিসেবে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় সবে মাত্র ঘোষণা করেছে যে কলকাতা হলো দেশের সবকটি মেট্রোপলিটান শহরের মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ বান্ধব নগরী। এটা আমাদের রাজ্য সরকারের এক ধারাবাহিক পরিবেশ সচেতনা মূলক কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য সফলতার অবদান।’
বিগত বেশ কয়েক দশক যাবৎ কলকাতা দূষণ নগরী হিসেবে এক প্রকার ভারত সরকারের কাছে দুয়ো রানি হিসেবে উপেক্ষিত হয়ে এসেছে। এই নগরীর কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের দৈনিক হার বরাবরই ছিল স্বাভাবিক মাত্রা থেকে অনেকাংশে বেশি। আক্ষরিক অর্থেই এমন এক নেতিবাচক পরিস্থিতির প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কলকাতা আজ সারা দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। এমন সব তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি তিনি এও বলেন, ‘মুম্বাই, চেন্নাই, দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, পুনে এবং আহমেদাবাদ হলো ভারতের উল্লেখযোগ্য মেট্রোপলিটান শহর। প্রত্যেকটি শহর নিজের মতো করে পরিচ্ছন্নতা রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশ সহায়ক হবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে আমরাও সবাই মিলে রাজ্য সরকারের নির্দেশিত গাইডলাইন অনুসরণ করে কলকাতার জন্য অবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমরা এই দৌড়ে যে প্রথম হবো দেশের মধ্যে নজীর গড়তে পেরে, সেটা আমাদের কাছে আরও মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা প্রকৃতই কঠিন। কিন্তু তার চেয়েও অনেক কঠিন হলো, এই শ্রেষ্ঠত্ব আগামী দিনে বজায় রাখার সংকল্প গ্রহণ করা। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও আমরা ভারতের কাছে ফের নয়া দৃষ্টান্ত রচনার পথিকৃৎ হয়ে উঠবো।
এমনিতেই প্রতিটি শহরাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ গাছ থাকা ভীষণ রকমের আবশ্যক। এবিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের সুনির্দিষ্ট বিধি জারি করা রয়েছে সমগ্র ভারতের জন্য। সেই নিয়ম অনুযায়ী দেশের প্রতিটি শহরের ৩৩% জমি সবুজায়ণ করতেই হবে বনসৃজনের মধ্যে দিয়ে। তাই কলকাতা সহ আমাদের রাজ্যে এই সবুজ বিধি আক্ষরিক অর্থে পালনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কার্যত উঠে পড়ে লেগেছে। এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কল্যাণবাবুর অভিমত, ‘আমরা কলকাতার পাশাপাশি রাজ্যের সমস্ত শহরগুলিতে আরও বেশি করে বনসৃজনের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছি। দূষণমুক্ত পশ্চিমবঙ্গ আমাদের স্বপ্ন। সুতারাং গাছ হচ্ছে আমাদের এই সংকল্পের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।’
পরিবেশ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য পেশ করলেন এই আলোচনা সভায়। তিনি বলে উঠলেন, ‘আমরা শুধু কলকাতার শ্রেষ্ঠত্ব দখল করে আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছি না। আমরা পরিবেশ রক্ষায় রাজ্যকেও ভারত শ্রেষ্ঠ করার লক্ষ্যে প্রাণপাত কাজ করে চলেছি। এর জন্য আমরা নানাবিধ নিত্যনতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে চলেছি এবং তা বাস্তবায়নের পথে নিরন্তর এগিয়ে চলেছি এতটুকু সময় অপচয় না করে।’ এই নিয়ে এক নয়া দৃষ্টান্ত পেশ করে তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘বিহারের সঙ্গে আমাদের রাজ্যের সীমানা হলো তিনশো কিলোমিটার দীর্ঘ। আবার ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত হচ্ছে পাঁচশো কিলোমিটার লম্বা। সুতরাং এই দুটি রাজ্যের মোট আটশো কিলোমিটার পরিধি জুড়ে আমাদের রাজ্যে গাছের বীজ রোপণের কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি। ফলে বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের এলাকা বরাবর আমরা একটা দীর্ঘ নয়া অরণ্য পরিধি গড়ে তুলবো। এতে পার্শ্ববর্তী অন্য রাজ্যের উৎপাদিত দূষণ পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশকে কোনও ভাবেই দূষিত করতে পারবে না। আমরা নিশ্চিত এই উদ্যোগের ফলে আগত দিনে আমাদের রাজ্যের পরিবেশ দূষণের পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেকটা তলানিতে এসে ঠেকবে।’ কল্যাণবাবুর মতে, ‘চীনের প্রাচীর যেমন মনুষ্য পারাপারের পক্ষে দুর্ভেদ্য। তেমনটি পশ্চিমবঙ্গ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গৃহীত নয়া এ হেন কর্মসূচি রূপায়ণ করার সঙ্গে যে সবুজ দেওয়াল আমরা গড়ে তোলার প্রয়াস করছি তাতে বিহার সহ ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত বরাবর অচিরেই দূষণ দুর্ভেদ্যের একটা নতুন বলয় হয়ে উঠবে। আমাদের এই কার্যক্রম আজ সারা দেশের কাছে এক অভিনব দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে।’
কঠিন বাস্তবতার আয়নায় কলকাতাকে একটু পর্যবেক্ষণ করলেই খালি চোখেই স্পষ্ট অনুভব করা যায়, পরিবহন চলাচলজনিত নির্গত ধুলো ও কার্বণ ডাইঅক্সাইড এই শহরের আকাশকে নিয়ত মলিন থেকে মলিনতর করে চলেছে অবিচ্ছেদ্য গতিতে। দূষণ-দানবের এমন একচ্ছত্র একচেটিয়া থাবার মধ্যেও কিন্তু কলকাতার জন্য সুখী গৃহকোণের একটা সুখময় লেফাফা ইতিমধ্যেই উপস্থিত। কলকাতার আকাশে বাতাসে যে ১০ মাইক্রোমিটারের (পিএম১০) চেয়ে কম ক্ষুদ্রাতীত দূষণ ছেয়ে আছে, তা কিন্তু অনায়াস ছন্দে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শহরবাসীর ফুসফুসে গিয়ে আশ্রয় নেয় অতি সহজেই। ফলে কলকাতাবাসীর পক্ষে এই ধরণের দূষণ প্রকৃতই অভিশাপের, অন্তত নানাবিধ শারীরিক রোগের আশঙ্কায়। আর এখানেই অতি গ্রীষ্মের সন্ধ্যার আবাস জানালায় দক্ষিণা বাতাস প্রবেশের মতো সুখবরটি হলো, কলকাতার বহমান বায়ুতে পিএম১০ দূষণ মাত্রা ক্রমেই যে নিম্নগামী। সাম্প্রতিক অতীতে যে ভয়াবহ মাত্রাটি ছিল ৫৭.৩%’এ। বর্তমানে সেটি ৪৩%’এ কমে দাঁড়িয়েছে। এই সাফল্য কিন্তু এক লহমায় পুরস্কার হিসেবে হাতের মুঠোয় এসে উপস্থিত হয়নি। রাজ্য সরকারের পূর্ত দফতর, পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও কলকাতা পৌরসভা রীতিমতো পরিকল্পনা রচনা করে এবং রাজ্য পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরামর্শে দূষণ রোধের এক বাস্তব সম্মত রূপরেখার সম্মিলিত প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। বিভিন্ন গাড়ির উপর কড়া নজরদারি ও পোক্ত নিয়ম আরোপ করা, সিএনজি ও ইলেক্ট্রিক চালিত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা, একইসঙ্গে বিভিন্ন রাস্তাঘাট সংস্কার করা ছিল এই সার্বিক পরিকল্পনার অন্যতম কার্যকরী ব্লুপ্রিন্ট। ফলে শহরে পূর্বের তুলনায় কলকাতার রাস্তায় যানবাহনের ব্যবহারে বড় রকমের ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। আর এতেই পিএম১০ দূষণ হ্রাসের বাজিমাত সম্প্রসারিত হয়েছে তিলোত্তমার অঙ্গে রঙ্গে।
এতো কিছুর মধ্যেও প্লাস্টিক ব্যাগ প্রকৃতই শিরঃপীড়ার মস্ত বড় কারণ হয়ে উঠেছে আমাদের এই পরিচিত সমাজে। এটা শুধু কলকাতার সমস্যা নয়, এই প্রতিবন্ধকতা আজ কলকাতার গন্ডি অতিক্রম করে রাজ্যের প্রতিটি অঞ্চল পেড়িয়ে দেশের নয়টা দিগন্ত স্পর্শ করে তিলে তিলে সংক্রামিত হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তর থেকে প্রত্যেক প্রান্তিকে। আমার প্রকাশ্যে সর্বত্র মুখে বলি প্লাস্টিক ব্যাগ পরিহার করা অতি আবশ্যক। কিন্তু আমাদের কথা আর কাজ কি এক? মোটেও না। বিকেলে কোনও এক ওজনদার অডিটোরিয়ামে প্লাস্টিক বর্জনের বিপ্লবে গলা ফাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে কোন যাদুমন্ত্রে এই বিপ্লবী যে পরিবেশ আসামীতে পরিণত হয়ে যায়, কে জানে? নৈতিকতায় মাই ফুট করে মাছের দোকানে এই আমিই অতঃপর খুঁজে নিই মাছ কিনতে প্লাস্টিক প্যাকেট। এখানেই আক্ষেপ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়। হতাশার সুরে তিনি বলেন, ‘ইস্যুটা যদি প্লাস্টিক ব্যাগ হয় তবে এটি হলো বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। আমরা টেকনোলজির সাহায্যে পলিব্যাগ তৈরি করতে ১০ মিনিটও ব্যয় করি না। অথচ ব্যবহারের পর বর্জ্য হিসেবে এটি মাটিতে মিশে যেতে চার হাজারের বেশি সময় নষ্ট হয়। আমরা এটি ব্যবহারের নিষেধ করে অপরকে সচেতন করতে যথাযথ প্রয়াস করি ঠিকই, কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই নীতি জ্ঞান যে নিজেরাই মানি না পদে পদে। পলিব্যাগ আমাদের প্রায় সকলেই আজকাল নির্ভেজাল জ্ঞানপাপী করে তুলেছে।’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের কথায় সম্মতি জানিয়ে একরাশ শ্লেষ ব্যক্ত করেন রাজ্য পরিবেশ দফতরের কর্তা কল্যাণ রুদ্র। তিনি নিজের বিষন্নতা প্রকট করে সংকোচের সঙ্গে বলেন, ‘আমাদের একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। তাই আমরা পলিব্যাগ ব্যবহারে সমাজে নিয়মকানুন লাগু করি। ব্যবহার কমানোর আবেদন মানুষকে করি। সচেতনতার নানাবিধ সভা করি। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এর ক্ষতিকারক দিক নিয়ে প্রশিক্ষিত করি পড়ুয়াদের। অবশেষে আমাদের পরিধিতে গিয়ে জেনে বুঝে ধাক্কা খাই। চুপ করে যেতে বাধ্য হই। কারণ বাজারে বায়ো-পলিব্যাগ এসে গেলেও আমরা সব বুঝেও পলিব্যাগ চিরতরে উৎপাদন বন্ধ করতে সক্ষম নই। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেটারই বড় অভাব আমাদের দেশের কেন্দ্র থেকে প্রতিটি রাজ্যে। এমনতর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমরা আমলা হিসেবে নিতে পারি না। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি এবিষয়ে আমাদের হাত পা বাঁধা। নাগরিক সচেতনতার চেয়েও আজ ভারতের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সচেতনতা। একদিন হয়তো সেই স্বপ্ন বাস্তব হবে যেদিন ভারতে পলিব্যাগ আর উৎপাদিত হবে না। আমি সেই নির্মল দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি।’
কলকাতা তাই আজ এই মন্ত্রে যে আজ নিজেই বিশ্বাসী। আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে। জাগো ভারত জাগো। একটিবার চেয়ে দেখ তোমারই নির্মল তিলোত্তমাকে।