খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে ভারতের ৪০ শতাংশ মানুষের দু’বেলা ঠিকমতো অন্ন জোগানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্কট নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা পিডাব্লিউসি-র ভয়েস অব দ্য কনজিউমার রিপোর্ট ২০২৫-এ একথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বের খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত সঙ্কট নিয়ে সংস্থা তার রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে এই সমস্যা চরম আকার নিয়েছে। ভারতে ৮৪ শতাংশ মানুষ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যায় দুর্ভোগে রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের পরিবারে দু’বেলা ঠিকমতো অন্নের জোগান দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ৩২ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের আয় কমে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির চাপে তাঁরা খাওয়ার খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। ৭ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন কোনওমতে একবেলা খাওয়ার খরচ জোটাতে হচ্ছে। এই সংস্থা বিশ্বজুড়ে এনিয়ে ২৮টি দেশে ২১ হাজার ক্রেতা এবং ভারতে ১ হাজার ৩১ জন ক্রেতার উপর সমীক্ষা চালিয়েছে।
এই রিপোর্টে ভারতে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর কি প্রভাব ফেলছে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। হিসাব করে দেখানো হয়েছে, ৪ বছর আগে সাধারণ মানুষের মোট আয়ে সঞ্চয়ের যে হার ছিল, বর্তমানে সেই সঞ্চয়ের হার কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে, অন্যদিকে পরিবারে ঋণের বোঝা বেড়ে গিয়েছে।
ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এনপিসিআই) তথ্যে জানা গিয়েছে, আর্থিক সংস্থাগুলিতে পরিবারের দেনা মেটানোর হার বেড়েই চলেছে। যা প্রমাণ করে সেই সব পরিবারে সঞ্চয় কমে গিয়ে ঋণের বোঝা বেড়ে গিয়েছে। বর্তমান আর্থিক বছরের প্রথম চার মাসে সাড়ে ৩ লক্ষ কোটি টাকা দেনা বাবদ সংগ্রহ করেছে ঋণ সংগ্রহকারী এজেন্সিগুলি। এতেই স্পষ্ট, বিপুল অর্থ শুধু দেনা হিসাবেই সংগ্রহ হচ্ছে। গত বছর আবহাওয়ার বিপর্যয়ে ফসল নষ্ট হওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। চলতি বছরেও আবহাওয়া বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে। ফলে খাদ্যপণ্যের দামি বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বেড়েছে।
বিশ্বের মধ্যে ভারত একমাত্র দেশ যেখানে ৫৭ শতাংশ মানুষ তাঁদের দৈনিক জীবনযাপনের খরচ নিয়ে উদ্বেগে দিন কাঠান। দেশে শ্রমজীবী মানুষের সরকারি সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা খুব কম থাকায় সংসার চালাতে তাঁদের ধারে বা ঋণে জড়িয়ে যেতে হয়। বিশ্বের অন্য দেশে সরকারি সামাজিক সুরক্ষা বেশি থাকায় এই সমস্যা অনেক কম।
একদিকে ভারতে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলা, অন্যদিকে অসংগঠিত ছোট মাঝারি শিল্পের সঙ্কটে ছাঁটাই এবং মজুরি কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি মোদী সরকার এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে যে দাবি করেছে তা ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে দেশের ৪০ কোটির বেশি মানুষ রয়েছেন অসংগঠিত ছোট-মাঝারি উৎপাদন শিল্পে। তা আদৌ ঘুরে দাঁড়ায়নি। বাজার সঙ্কটে তারা ধসে পড়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চের তুলনায় এপ্রিল থেকে জুনে তার উৎপাদন কমেছে ৯.৩ শতাংশ হারে। এতে ৪.৭ শতাংশ ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে কাজ হারিয়েছেন অন্তত ১২.৮৬ কোটি শ্রমিক।
এদিকে অসংগঠিত ছোট ও মাঝারি শিল্প সঙ্কটের বড় কারণ হলো বাজারে ক্রেতার অভাব এবং ব্যাঙ্ক ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া। তাদের বেশিরভাগের স্বল্প সুদের ব্যাঙ্ক ঋণের সুযোগ মেলে না। সমীক্ষায় প্রকাশ, ৬ লক্ষ ৩০০ ছোট-মাঝারি অসংগঠিত শিল্পের মধ্যে ৮৬ শতাংশই ব্যাঙ্ক ঋণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মহাজনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালাতে হয়েছে। তার উপরে বাজারে সঙ্কট। এই অসম প্রতিযোগিতায় টিঁকতে পারছে না ছোটও মাঝারি শিল্পগুলি। কেন্দ্রের পিরিওডিক লেবার সার্ভে রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের মোট শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ রয়েছেন অসংগঠিত ছোট ও মাঝারি শিল্প। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশ হয় অসংগঠিত ছোট ও মাঝারি শিল্পে। ফলে ছোট ও মাঝারি শিল্পের সঙ্কট আসলে জাতীয় সঙ্কট হিসাবে দেখা উচিত ছিল কেন্দ্রের। তাতে কোনও গুরুত্ব না দেওয়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট ও মাঝারি শিল্প। যেখানে কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়ে আয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের, সেখানে জিএসটি কমিয়ে বাজারে চাহিদা বাড়ানো অলীক কল্পনা বলে
জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।