সরস্বতী শুধু শিক্ষিতই নয় বোধবুদ্ধি সম্পন্ন বিবেকবান মানুষও সৃষ্টি করে

প্রতীকী চিত্র

নিশীথ সিংহ রায়

হিন্দুরা বিশ্বাস করে দেবী সরস্বতী হচ্ছেন বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, সাহিত্য, সঙ্গীত, কলা বা শিল্পের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি সকল সংশয় ছেদকারিণী, সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী ও সকলের উপজীবিকা স্বরুপিণী। এমনকি জীবনে চলার ক্ষেত্রে আমাদের যে মূল পথ সেই সততার প্রতীক দেবী সরস্বতী। জীবনে চলার পথে একটা মানুষের যত সৃজনশীল গুণের দরকার পড়ে তার সবকিছুরই দেবী হিসেবে সরস্বতীকে ধরা হয়। একারণে তাঁর হস্তে থাকে বীণা। তার মানে এটা বোঝায় সরস্বতী সৃজনশীল ও বিচক্ষণতার দেবী। সরস্বতীকে শুদ্ধিকরণের দেবী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। তাহলে মানুষের বিচক্ষণতা, সৃজনশীলতা বা শুদ্ধিকরণ কল্পে দেবী সরস্বতী পূজিত হন এবং তাঁকে জ্ঞানের দেবী বলা হয়। আর আজ সেই জ্ঞান, শিক্ষার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর আরাধনা। সরস্বতী পুজোর পরেরদিন ‘শীতলা ষষ্ঠী’ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং এদিন অনেক জায়গায় ‘অরন্ধন’ প্রথার পালিত হয়। তাঁর বাহন হাঁস বা রাজহাঁস। সরস্বতীর বাহন হাঁস হবার কারণ পৃথিবীতে একমাত্র হাঁস অসার ফেলে রেখে সার খেতে পারে। যেমন দুধ আর জলের মিশ্রণ থাকলে হাঁস জল ফেলে রেখে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করতে পারে বা কাদায় মিশ্রিত খাবার থাকলে সেখান শুধু নিজের খাবারটুকু সংগ্রহ করতে পারে।

হাঁসের এই অসাধারন গুণ, ক্ষমতা বা বুদ্ধিমত্তার জন্য সে দেবী সরস্বতীর বাহন। ঠিক এই কারণেই সৎ, বিবেকবান, আদর্শ নিষ্ঠা মানুষদের দেবী সরস্বতীর অনুসারী বলা হয়। আর একটা কি বিস্ময়কর ব্যাপার দেবী সরস্বতী নিজে সাদা বস্ত্র বা পীতবস্ত্রধারিণী। এমন কি তাঁর যে বাহন হাঁস সে পর্যন্ত সাদা রংয়ের। কিন্ত সরস্বতী নিজে ‘হলুদ’ রং পছন্দ করেন। সেকারণে সরস্বতী পুজোর দিন আমরা দেখি রাস্তাঘাট যেন কোনো শিল্পীর আঁকা রঙিন ক্যানভাস। স্কুল কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো রঙের মেলা। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সাথে রঙিন পরিধানে নিজেদের সজ্জিত করে। বিশেষত হলুদ রংয়ের। মেয়েদের ক্ষেত্রে এর সাথে যোগ হয় আবার সাদা কাপড় সাথে লাল পাড় শাড়ি। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে! সারা বছর জিন্স পরলেও এদিন দেখা যায় পাজামা-পাঞ্জাবী বিশেষত সেই হলুদ রংয়েরই। এদিন শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার পরনেই ম্যাচিং জামা-কাপড় থাকে না, থাকে বিবাহিত মানুষদেরও। তা সে মধ্য, বৃদ্ধ যে বয়সেরই হোক না কেন। মানে সরস্বতী পুজোর ক্ষেত্রে পোশাক একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। চারদিকে শুধু রঙিনের মেলা।


সারা ভারতেই দেবী সরস্বতীর পুজো হয়। হয়তো ভিন্ন নামে। আর পশ্চিমবঙ্গে একটা মানুষ তার জীবনের সব পর্যায়েই সরস্বতী পুজো করে থাকে। আমাদের জন্মলাভের পর আমরা নিজেরা প্রথম যে পুজোটা করি সেটা হচ্ছে দেবী সরস্বতীর। আমরা আমাদের জ্ঞান লাভের যে মাধ্যম সেই বই-খাতা দেবী সরস্বতীর পায়ে অর্পণ করি এবং আমাদের শিক্ষাজীবন যতদিন থাকে ততদিন আমরা এভাবেই সরস্বতীকে পূজা করি। এরপর আমাদের সন্তানসন্তনীদের ক্ষেত্রেও একই ভাবে আমরা উদ্যোগী হই যাতে সে শিক্ষা লাভ করে মানুষের মত মানুষ হতে পারে। এদিন অনেক শিশুর ‘হাতেখড়ি’ হয়। বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। যেখানে শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র আছে সেখানে সরস্বতী দেবীর আরাধনা করা হয়। যাইহোক এভাবেই বংশ পরম্পরায় দেবী সরস্বতী পূজিত হয়ে আসছেন। তাই বঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেবী সরস্বতী। বসন্ত কালে শুক্লপক্ষের পঞ্চম তিথিতে দেবী সরস্বতীর পুজো হয়। সেকারণে সরস্বতী দেবীকে ‘বাসন্তী’ দেবীও বলা হয়। সাধারণত এটা জানুয়ারির শেষ দিকে বা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে পড়ে। ২০২৫ সালে দেবী সরস্বতী আজ মানে ফেব্রুয়ারির মাসের তিন তারিখে পূজিত হচ্ছেন।

দেবী সরস্বতীর জন্ম এবং জীবন বিভিন্ন কাহিনীতে ভরা। হিন্দু পুরাণ মতে সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী যাঁর অপর নাম শারদা ও ভানি। তাঁদের সন্তান পৃথিবীর প্রথম মানুষ মনু যাঁর দ্বারা মনূষ্যকূলের সৃষ্টি হয়েছিল। এদিকে ব্রম্ভার স্ত্রী রুপে গায়ত্রী দেবীকেও পাওয়া যায়। যাঁর তিন সন্তান মনু, নারদ ও বশিষ্ঠ মুনি। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সরস্বতী ব্রম্ভার মানসকন্যা। এটাও বলা হয় ব্রম্ভা প্রথম তাঁকে দেবীরূপে পূজা করেন। আর এক মত তিনি ব্রম্ভার মুখগহ্বর থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন এবং বিশ্ব সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিলেন। সরস্বতী প্রথমে নদী হিসেবে পূজিত হতেন পরে তাঁকে শিক্ষার দেবী রূপে মাণ্য করা হয়। দেবীভাগবত পুরাণ অনুযায়ী দেবী সরস্বতী বিষ্ণুর জিহ্বাগ্রে থেকে হয়েছিলেন। আবার এটাও প্রচলিত দেবতাদের সমুদ্র মন্থনের সময় দেবী সরস্বতী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জন্ম, বিবাহ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকলেও একটা ব্যাপার সত্যি যেটা হলো দেবী সরস্বতী বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, সঙ্গীত বা শিল্প কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী এবং এভাবেই তিনি বিশ্বে পূজিত হন। ভারত বা বাংলার এই অস্থির সময়ে দেবী সরস্বতীর কৃপায় বিবেকবোধ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সৃজনশীল, সৎ, ভাল মানুষের উদয় হোক যাঁরা ভাল-খারাপের সংজ্ঞা সঠিকভাবে নিরুপম করে বিচক্ষণতার সাথে জাতিকে সঠিকভাবে চালিত করবে।