রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
দাঁড়ায়, যখন স্পষ্ট কর্মের আহ্বান আসে, লক্ষ্যলাভের উপায় তখন আর মানসিক বিলাস থাকে না, খুশিমত উহা বাছিয়া লইবার অবসরও থাকে না। গলার কাছে কেহ ছুরি ধরিলে দৃঢ়মুঠিতে সেই ছুরি ধরিয়া হত্যাকারীর দিকে তাহার ফলাটা জোর করিয়া আগাইয়া ধরা যতই বেতনাদায়ক হউক না কেন—খুন হইতে না চাহিলে উহা না করিয়া যেমন উপায় নাই, ঐতিহাসিক মুহূর্তে হিংসাত্মক পন্থা গ্রহণ করাও এইরূপ। বাঁচিতে হইলে প্রত্যেক জীবের পক্ষে হিংসা অপরিহার্য, এই হিংসা আমার পক্ষে অসহ্য; কিন্তু ইহার চেয়েও অসহ্য হিংসার পক্ষে ওকালতী। যুদ্ধ হইতে সদ্য ফিরিয়া আসা উন্মাদেরা তখনকার দিনে এই ওকালতীই করিত। এবং ইহার কথাই বারবুসের নিকট তৃতীয়পত্রে (এপ্রিল ১৯২২) আমি লিখিয়াছিলাম। এই উন্মাদেরা যুদ্ধের নিকৃষ্টতম শিক্ষাকে বিপ্লবের কাজে লাগাইতে চাহিয়াছিল অথচ বিপ্লবের লক্ষ্য যুদ্ধের নিকৃষ্টতম শিক্ষা হইতে আমাদের মুক্ত করা।
কোনো হিংসাই গর্ব করিবার মত গুণ হইতে পারে না। হইতে পারে বড়জোর একটি কঠোর কর্তব্য, যে কর্তব্য নির্ভীকভাবে সাধন করিতে হইবে অথচ যাহা লইয়া দম্ভ করা চলিবে না। হিংসা যে সংহার শক্তিকে বন্ধনমুক্ত করিয়া দিয়াছে তাহার সম্পর্কে কোনো দায়িত্বশীল বুদ্ধিমান রাষ্ট্রনেতা নিশ্চিন্ত হইতে পারেন না। আজ রোমের ড্যুচে মেশিনগানের প্রশংসা করিয়া উহা শিশুদের হাতে তুলিয়া দিতেছেন। কত বড় নির্বোধ, কত বড় দায়িত্বজ্ঞানহীন তিনি। ভীষণ নিয়তিকে লইয়া উল্লাসে খেলায় মাতা পৌরুষের পরিচয় নহে। প্রয়োজন হইলে উহাকে বিনাবাক্যে, বিনাদম্ভে তুলিয়া লওয়াই সত্যিকারের পৌরুষ।
আমি একথাও বলি, হিংসা শুধু শরীরের প্রতি নহে, মনের প্রতি হিংসা বলিয়াও একটা জিনিস আছে যাহা আমাদের একটুও কম বিচলিত করে না। ১৯২২ সালের জানুয়ারী মাসে বারবুসের জবাবে লিখিত আমার প্রথম খোলা চিঠিতে যাহা লিখিয়াছিলাম তাহাই এখানে বলিঃ ‘‘জয়লাভের জন্য জীবনের সর্বোচ্চ নীতিকে বারম্বার তাহারা বলি দিয়াছে, বলি দিয়াছে মানবতাকে, স্বাধীনতাকে এবং সকলের চেয়ে বড়, সত্যকে। মানবতার স্বার্থে বিপ্লবেরই স্বার্থ—এই নীতিকে সর্বদা রক্ষা করিতে হইবে। যে বিপ্লব এইসবকে উপেক্ষা করে, আজ হোক কাল হোক তাহার পরাজয় হইবেই; এবং এ পরাজয় বাস্তবক্ষেত্রের পরাজয় হইতে আরও সাংঘাতিক, এ পরাজয়ের অর্থনৈতিক অধঃপতন।’’
(ক্রমশ)