রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
এই সকল রচনার মধ্যে এমন একটি আলোচনা চোখে পড়িবে যাহাতে হিংসা ও অহিংসা এই দুই রণপদ্ধতি সম্মিলিত করিয়া ‘তৃতীয় যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত হওয়া। এই আলোচনা যতটা বাস্তব ক্ষেত্রের ব্যাপার ততটা তত্ত্বমূলক নহে। আমার শান্তির জন্য যোদ্ধাদলের’ বন্ধুগণ কেবলমাত্র দুই ধরনের যুদ্ধকেই জানিতেনঃ এক ধরনের যুদ্ধ যাহা জনসাধারণ তাহাতে প্রভুশ্রেণীর স্বার্থে যোগ দেয়; আরেক ধরনের যুদ্ধ যে যুদ্ধে প্রভুশ্রেণীর বিরুদ্ধে জনসাধারণ নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অবতীর্ণ হয় বা হইয়াছে। আমি দেখাইলাম আরেকটি ‘তৃতীয় যুদ্ধ’ রহিয়াছে, বর্তমান অবস্থায় তাহার মত সাংঘাতিক যুদ্ধ আর হইতে পারে নাঃ এই যুদ্ধ জনসাধারণের বিরুদ্ধে প্রভুশ্রেণীর যুদ্ধ। জার্মানীতে, ইতালীতে এবং (আজ স্পেনেও এই যুদ্ধ ইতিমধ্যেই শুরু হইয়াছে। ব্যাঙ্ক ও শিল্পপতিগণের অর্থে পরিপুষ্ট হইয়া ফাশিজম্ যেখানেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেখানেই এই যুদ্ধ চলিতেছে। আক্রমণের উদ্যোগ আর বিপ্লবের হাতে নাই। প্রকৃত বিপদ কোথায় শত্রু তাহা বুঝিতে পারিয়া অগ্রবর্তী ঘাটি আগলাইয়া চলিতেছে। বিপ্লবকে তাহারা প্রারম্ভেই বিনাশ করিতে চায়। (১৯৩৩ সালের ১৫ই মার্চ)
৩৯। সংগ্রামের প্রথম দিকে হিট্লারী শাসন আমার সহিত কিছুটা সংযত ব্যবহার দেখাইল। ভের্সাই সন্ধির অবিচারের বিরুদ্ধে পরাজিত জার্মানীর পক্ষ আমি চিরদিনই সমর্থন করিয়া আসিতেছিলাম। এই সংযত ব্যবহার হয় ত স্মরণ করিয়াই তাহারা আশা করিয়াছিল, জাতিগত প্রভুত্বের যে পাশবিক স্বৈরশাসন জার্মানীতে আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতেছিল তাহার সমর্থনে তাহারা আমার জার্মানীর প্রতি সহানুভূতিকে কাজে লাগাইত পারিবে। এমন কি যেদিন ‘হিট্লারী সংগ্রামের বিরুদ্ধে সরকারী সাহায্য সমিতি’ স্বাক্ষরকারিগণের মধ্যে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়া হাজার হাজার আবেদনপত্র বিতরণ করিয়াছে, সেদিনও জার্মানীতে তাহারা এই ব্যাপার না জানিবার ভান করিয়াছে। তাহারা যেন আমায় পথভ্রান্ত বন্ধু হিসাবেই দেখিতেছে, এইরূপ ভান করিল। সমস্ত ব্যাপারটা ভালোভাবে জানিয়া অভিমত ব্যক্ত করিবার জন্য তাহারা আমার নিকট আবেদন জানাইল। এমন কি তাহারা আমার স্বপক্ষে টানিবার চেষ্টা করিল। ১৯৩৩ সালের ১৯শে এপ্রিল জেনেভাতে জার্মান কন্সাল আমাকে জানাইলেন ‘কলা ও বিজ্ঞানের জন্য’ গ্যায়টে-পদক আমাকে দিবার জন্য রাইখের প্রেসিডেন্ট ভন হিণ্ডেনবুর্গ নাকি তাহাকে নির্দেশ দিয়াছেন।
উত্তরে আমি জানাইলাম যে, যদিও এই সম্মান প্রদর্শনের আন্তরিকতাকে আমি উপলব্ধি করি তথাপি ইহা আমি প্রত্যাখ্যান না করিয়া পারি না (২০শে এপ্রিল):
‘‘আজ জার্মানীতে যাহা চলিয়াছে এবং যে ভাবে স্বাধীনতা দলিত হইতেছে, গভর্ণমেন্ট-বিরোধী দলগুলির উপর যে অত্যাচার চলিতেছে, ইহুদীদের উপর যে কলংককর পাশবিক ব্যবহার করা হইতেছে তাহার ফলে সমগ্র জগতের সাথে আমার মনেও তীব্র ঘৃণা জাগিয়া উঠিয়াছে। এই নীতি মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে অপরাধ। যে গভর্ণমেন্ট আদর্শে ও কর্মসূচীতে এই নীতি প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়াছে তাহার নিকট হইতে সম্মান গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নহে।’’
কিন্তু আমার এই প্রত্যাহার সাধারণ্যে প্রকাশ করিতে দেওয়া হইল না। একটিও কথা না বলিয়া ইহাকে ঢাকিয়া ফেলা হইল। প্রাগ ও কোপেনহেগেন হইতে প্রকাশিত জার্মান সামরিক পত্রিকাগুলি মারফত আমার প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি জার্মানীতে পৌঁছানো যখন ঠেকানো গেল না তখন সরকারী সংবাদপত্রগুলি এ-সম্পর্কে মুখ খুলিতে বাধ্য হইল। প্রথম প্রথম কিছুটা সংযম রহিল, যেন অনেকটা বেদনার সঙ্গেই।
(ক্রমশ)