রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর…
জাঁ ক্রিস্তফ-এ কোলা ব্রোঞয়ঁ, ক্লেরাঁবোল-এ আমি ব্যক্তিগত বিবেক ও স্বাধীন মনের শক্তিকে উচ্চ আসন দিতে গিয়া যাহা কিছু বলিয়াছি বা করিয়াছি আমার বর্তমান মত ও পথের সহিত তাহাদের অসামঞ্জস্য নাই; তাহারা ও আনেৎ-এর মত বিপ্লবের বাহিনীতে যোগদান করিয়াছে। ইহার মধ্যে আকস্মিক বা অদ্ভুত কিছু নাই, তাহাদের বিকাশেরও নিয়মানুসারেই ইহা হইয়াছে।
কিন্তু এই বিকাশের পশ্চাতে যুক্তির প্রেরণা ততটা ছিল না যতটা ছিল তাহাদের ও আমার মানসিক প্রকৃতির প্রেরণা। বুর্জোয়া সংস্কৃতির যুগে আমাদের এই মানসপ্রকৃতি গঠিত হইয়াছিল; এই যুগের আবহাওয়ায় যে চিন্তার দৈন্য ও বিহ্বলতা দেখা দিল আমাদের মন ও মস্তিষ্ককে তাহা আঘাত করিয়াছিল, আচ্ছন্ন করিয়াছিল; কিন্তু কর্মের মুখোমুখি আসিয়া আমি কিংবা আমার সৃষ্ট চরিত্রগুলি কখনও পথ ভুল করে নাই; আমরা চিরদিনই ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে লড়াই করিয়া আসিয়াছি।
জাঁ ক্রিস্তফ, কোলা, ক্লেরাঁবোল, আনেৎ ও তাহার পুত্র বাঁচিয়াছিল ও মরিয়াছিল সমস্ত মানুষের কল্যাণে। সমাজ হইতে তাহাদের লক্ষ্যবস্তুকে পৃথক করিবার কথা তাহাদের কাহারও মনে হয় নাই— ‘‘সবার বিরুদ্ধে যে একক’’ এই লক্ষ্যবস্তুকে বাঁচাইবার জন্য যে অন্য সকলের বিরোধিতা করিয়াছিল, একথা তাহারও মনে হয় নাই। জনগণকে তাহাদের প্রয়োজন ছিল সেবা করিবার জন্য, সেবিত হইবার জন্য নহে। মনে, কাজে আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়া তাহারা জনগণের মধ্যে নিজেদের মিলাইয়া দিয়াছিল। তাহারা নিজেরাও ছিল জনসাধারণ—কর্মরত শ্রমজীবী জনসাধারণ। তাদের স্বাতন্ত্র্য ছিল মূলত সমষ্টিগত; পথে ছায়া দেখিলে ঘোড়া যেমন হঠাৎ মাথা তুলিয়া পিছু সরিয়া আসে তেমনি আমার মত তাহারাও তাহাদের পবিত্র ‘‘স্বাতন্ত্র্যবাদে’’ বাহিরের স্পর্শ লাগিবামাত্রই সতর্ক ও সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন।
এই স্বাতন্ত্ব্যবাদের মত মোহময় কথাগুলির জন্য আমরা সর্বদা প্রাণ দিতে প্রস্তুত; কেবলমাত্র দীর্ঘ বেদনাময়, মোহ ও ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতার পর আমরা দেখিতে পাই যে, আমাদের এই বিশ্বাস, সত্য ও সঙ্গত বিশ্বাস এমন মৃত ও গলিত কতকগুলি দেবতাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া তোলে যাহাদের সাহায্যে একটি চতুর সংস্কৃতি আমাদের প্রবঞ্চিত করিয়া এই সকল কথাগুলিকে শূন্য করিয়া অহরহ সেগুলি এমন স্বার্থ দিয়া পরিপূর্ণ করিয়া তোলে কথাগুলির মূল ভাবের যাহা সম্পূর্ণ বিপরীত।
(ক্রমশ)