রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
অল্পকালের জন্য তাহাদের দীপ্তি থাকে, তারপর তাহারা শুকাইয়া যায়; লোকে তখন সেগুলিকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে। মৃত্যুর বিরুদ্ধে, হত্যাকারীর বিরুদ্ধে, মানব সমাজের দলনকারীর বিরুদ্ধে জীবনের নিকট আবেদন জানাও। খনিকের ধনমত্ততা, সাম্রাজ্যবাদীর ক্ষমতামত্ততা, বৃহৎ ব্যবসায় কোম্পানীগুলির একনায়কত্ব, রক্তপানমত্ত ফ্যাশিজমের নানারূপ—এই সকলের বিরুদ্ধে জীবনের নিকট আমি আবেদন জানাই। হে শ্রমজীবী শ্রেণী, আমরা হাত প্রসারিত করিয়া দিতেছি, আমরা তোমাদেরই,—আমাদের মিলিত হইতে দাও।
আমাদের মধ্যকার বিভেদ ঘুচিয়া যাক, সমগ্র মানবজাতি আজ বিপন্ন (সেকুর উভ্রিয়ে আঁতেরনাসিয়নাল নামক পুস্তিকার জন্য ১৩৩৪ সালের ১লা মে তারিখে লিখিত)।
যুদ্ধের ঠিক মধ্যেই বইখানি শেষ হইয়া যায়। এ-কথা মনে রাখিতে হইবে যে, এই যুদ্ধ ১৯১৪ সালের যুদ্ধের ঊর্ধ্বে পুস্তকের বিরোধী নহে। ১৯১৪ সালের যুদ্ধ জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ। ‘‘জাতি ও সভ্যতার দম্ভ লইয়া এই যুদ্ধের উৎপত্তি—ইহার ফলে উভয় পক্ষই ধ্বংস হইয়া গেল। ১৯১৪ সালে এই যুদ্ধের ঊর্ধ্বেই আমি ছিলাম এবং আমৃত্যু থাকিব’’ (১৯৩৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আঁন্দ্রে বেরতেকে লিখিত চিঠি)। ‘‘যে যুদ্ধ সত্যকারের যুদ্ধ, যে যুদ্ধের প্রয়োজন ও বিপুল সম্ভাবনা রহিয়াছে, সে যুদ্ধ হইবে আন্তর্জাতিক রণাঙ্গনে। সামাজিক, নৈতিক ও জাতিগত কুসংস্কারের বিপুল অস্ত্রসম্ভারে সমৃদ্ধ পুরাতন ধনতন্ত্রী সাম্রাজ্যবাদী জগতকে ধ্বংস করিয়া যাহারা নূতন জগত সৃষ্টি করিবার চেষ্টায় আছেন তাহাদের সকল কর্মে সকল আশায়, সকল দুঃখবেদনার মধ্যে আমি আছি।’ এবং যেহেতু শ্রমিকবিপ্লব আজ ‘‘আন্তর্জাতিক সংগ্রামে অগ্রসরমান সেনাবাহিনীর পুরোভাগে চলিয়াছে, এবং যে সংগ্রামের জন্মলাভের ফলে শ্রেণীহীন, ভৌগলিক ব্যবধানহীন নূতন মনুষ্য সমাজের সৃষ্টি হইবে’’ সেই হেতু এই বিপ্লবে আমার পরিপূর্ণ সমর্থন রহিয়াছে।
জাঁ ক্রিস্তফ-এ কোলা ব্রোঞয়ঁ, ক্লেরাঁবোল-এ আমি ব্যক্তিগত বিবেক ও স্বাধীন মনের শক্তিকে উচ্চ আসন দিতে গিয়া যাহা কিছু বলিয়াছি বা করিয়াছি আমার বর্তমান মত ও পথের সহিত তাহাদের অসামঞ্জস্য নাই; তাহারা ও আনেৎ-এর মত বিপ্লবের বাহিনীতে যোগদান করিয়াছে। ইহার মধ্যে আকস্মিক বা অদ্ভুত কিছু নাই, তাহাদের বিকাশেরও নিয়মানুসারেই ইহা হইয়াছে।
কিন্তু এই বিকাশের পশ্চাতে যুক্তির প্রেরণা ততটা ছিল না যতটা ছিল তাহাদের ও আমার মানসিক প্রকৃতির প্রেরণা। বুর্জোয়া সংস্কৃতির যুগে আমাদের এই মানসপ্রকৃতি গঠিত হইয়াছিল; এই যুগের আবহাওয়ায় যে চিন্তার দৈন্য ও বিহ্বলতা দেখা দিল আমাদের মন ও মস্তিষ্ককে তাহা আঘাত করিয়াছিল, আচ্ছন্ন করিয়াছিল; কিন্তু কর্মের মুখোমুখি আসিয়া আমি কিংবা আমার সৃষ্ট চরিত্রগুলি কখনও পথ ভুল করে নাই; আমরা চিরদিনই ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে লড়াই করিয়া আসিয়াছি।
জাঁ ক্রিস্তফ, কোলা, ক্লেরাঁবোল, আনেৎ ও তাহার পুত্র বাঁচিয়াছিল ও মরিয়াছিল সমস্ত মানুষের কল্যাণে। সমাজ হইতে তাহাদের লক্ষ্যবস্তুকে পৃথক করিবার কথা তাহাদের কাহারও মনে হয় নাই— ‘‘সবার বিরুদ্ধে যে একক’’ এই লক্ষ্যবস্তুকে বাঁচাইবার জন্য যে অন্য সকলের বিরোধিতা করিয়াছিল, একথা তাহারও মনে হয় নাই।
(ক্রমশ)