শিল্পীর নবজন্ম

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর

পারির বৃহৎ ‘নির্ভুল’ সংবাদপত্র-জগতে ও ১৭ই ডিসেম্বরের ল্য তাঁ পত্রিকায় আমার প্রতি আক্রমণের বহর দেখিয়া ঔদাসীন্য দেখাইতে শুরু করিল। যে সুইস শহরটিতে আমি থাকিতাম সেখান হইতে অনেক চিঠি পাইতে লাগিলাম। জেনেভার জনৈক কোমলহৃদয়া মহিলা লিখিলেনঃ ‘‘প্রত্যেক জার্মানকে হত্যা করা দরকার।’’ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জানাইলেন, ‘‘আঃ, জার্মানহীন ইউরোপ কী আরামের, কী শান্তির স্থানই না হইবে।’’


পাঠক সহজেই বুঝিবেন কেন তখন মানুষের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া আমি আবার আমার বিশ্বস্ত, উপেক্ষিত সহচর সংগীতকে বুকে টানিয়া লইলাম।

কিন্তু আরো কারণ ছিল। তখন আমার চোখ খুলিতে শুরু করিয়াছে; যুদ্ধে মিত্রশক্তির দায়িত্বও আমি আবিষ্কার করিতে শুরু করিয়াছি। ১৯১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষভাগে ব্রিটিশ ব্লুক বুক-এ আমি স্যার এডোয়ার্ড গ্রে’র সহিত জার্মান রাষ্ট্রদূতের ১লা আগস্ট তারিখের সাক্ষাৎকারের কথা পড়িয়া বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হই। জার্মান রাষ্ট্রদূত জানাইয়াছিলেন গ্রেট ব্রিটেন যদি নিরপেক্ষ থাকে তবে ফ্রান্স ও তাহার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের গায়ে হাত না দিবার প্রতিশ্রুতি দিতে জার্মানী রাজি আছে। গ্রে স্পষ্টভাবে হাঁ না কিছু জানাইতে অস্বীকার করায় বিমূঢ় জার্মানী কৌশলে পাতা ফাঁদে পা দেয়। সেই বিশাল বিভ্রান্ত জানোয়ার তখন তাড়া খাইয়া বেলজিয়ামে ঢুকিয়া পড়ে। ইংরাজ শাসকশ্রেণী ইহাই চাহিতেছিল। জার্মানী এইভাবে ফাঁদে পা দেওয়ায় তাহারা যুদ্ধে অবতীর্ণ হইবার জন্য ব্রিটিশ জনসাধারণের সম্মতিলাভের একটা সুযোগ পাইল।

আমি জানি স্যার এডোয়ার্ড গ্রে’র অনিশ্চয়তা-নীতির এই ব্যাখ্যার অনেকে প্রতিবাদ করিবেন (যদিও ইহার পরে আমাদের কিছু না বলা সত্ত্বেও ইংরাজ ঐতিহাসিকেরাই এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছেন)। কিন্তু আমার এই ব্যাখ্যা সত্য হোক বা না হোক সেদিন হইতে আমার মনে সংশয় ঢুকিয়াছে; আমার মনের পক্ষে এইটাই সবচেয়ে বড় কথা যে, সংশয় আজও যায় নাই। তাই আমি যুদ্ধের পাপের জন্য সমস্ত ইউরোপকে আক্রমণ করিলাম, দায়ী করিলাম সমস্ত রাষ্ট্রকে সমষ্টিগতভাবে। ১৯১৫ সালের ১১ই জানুয়ারী আমি লিখিলামঃ

‘‘ধীরে ধীরে আশঙ্কার সহিত আবিষ্কার করিয়াছি মিথ্যার বেসাতি একা জার্মানীই করে না। আমার কাছে প্রত্যেক যুদ্ধরত শক্তিই কম বেশি এই যুদ্ধের জন্য দায়ী।

এমন হইতে পারে যুদ্ধের ইচ্ছা জার্মানীর সবচেয়ে বেশি ছিল না। কিন্তু ইচ্ছা তাহার যতটুকুই থাক, এমন কদর্যভাবে তাহা আত্মপ্রকাশ করিয়াছে যে, প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের অপরাধ তাহারই সবচেয়ে বেশি দাঁড়াইয়াছে।’’

১৯১৪-১৫ সালের ঘটনাবলী চিন্তাধারায় একটা গভীর, আকস্মিক পরিবর্তন আনিল। এটা খুব ছোট কথা নয়। বহুদিন, বহুমাস ধরিয়া তীব্র-অন্তর্দাহের আগুনে পুড়িয়া আমার মধ্যে নূতন এক ব্যক্তিত্ব জন্ম লইল, মৃত অতীত সমাহিত হইল। সে সকল অন্ধকার দিনে হৃদয়মনে গভীর যন্ত্রণা বহিয়া আমি দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া মৃত্যুর আস্বাদ লইতে চেষ্টা করিলাম।’’

কিন্তু মৃত্যুর আলিঙ্গন বহুবার আমার মধ্যে জীবনের আস্বাদ জাগাইয়া তুলিয়াছে। সংগীতের মত মৃত্যুও আমার জীবনের এক বড় বিশ্বস্ত সহচর;

(ক্রমশ)