শিল্পীর নবজন্ম

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর

রাজন্যবর্গের পিতৃভূমি, গণতন্ত্রের পিতৃভূমি, ধর্মযুদ্ধের পিতৃভূমি, উপাসনামন্দিরের পিতৃভূমি আর পিতৃভূমি বিপ্লবের।


১০ই আগস্ট তারিখে ডায়েরীতে আমি লিখিলামঃ ‘‘আমি কি করিতে পারি? এই যুদ্ধ সকলেই চাহে। ইহার বেদীমূলে নিজের রক্ত দান করিতে সকলেই ব্যগ্র। আমি আর তাহাদের করুণা করি না। নিয়তি নিজের পথে চলুক। কিন্তু ঘৃণাকে আমার হৃদয়ে প্রবেশ করিতে দিব না।’’

“De profundis clamans… হে স্বর্গীয় শান্তি, হে আমার সংগীত, ঘৃণার তলদেশ হইতে আমি তোমাকে উপরে তুলিব…’’

তখন আমি ‘‘আরা প্যসিস’’ নামক গাথাটি লিখি (আগস্ট ১৫-২১)। যুদ্ধের মধ্যে এইটি আমার প্রথম সন্তান। কিন্তু শিশুটিকে আমি আমার নিজের কাছে রাখিলাম। আমি ছাড়া কে আর ইহার কণ্ঠস্বর শুনিবে। এক বৎসরের মধ্যে কাহাকেও ইহা শুনাইতে সাহস করি নাই। এক বৎসরেরও অনেক পরে ১৯১৫ সালের বড়দিনের সময় সুইস পত্রিকাগুলিতে উহা প্রকাশিত হইল। কোনো ফল হইল না; হইল শুধু কিছু স্থূল রসিকতার উদ্রেক।

ইতিমধ্যে প্রতিদিন আসিতে লাগিল বিপর্যয়ের সংবাদ। মন একেবারেই ভাঙ্গিয়া পড়িল। সমগ্র বেলজিয়ামে আগুন জ্বলিতেছে; ফ্রান্স পরিবেষ্টিত। মনে হইল বন্ধু, দেশ, সভ্যতা, সবকিছু যেন পরিপ্লাবিত হইয়া গিয়াছে; মনে হইল নিজেও যেন উহাদের সাথে কোনো জঠরগহ্বরে আসিয়াছি। কখনও কখনও অন্যগুলির চেয়ে সাংঘাতিক কোনো অপরাধের কথা শুনিয়া আতঙ্কে আর্তনাদ করিয়া উঠিতে লাগিলাম। (২৯শে আগস্ট—১লা সেপ্টেম্বর তারিখে গেরহার্ড হাউপট্মানকে লিখিত চিঠি)। কোনো সেনাবাহিনীর চেয়ে ও কোনো দেশের চেয়েও বড় কোনো কিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রধূমিত হইয়া উঠিতেছিল। এই বিদ্রোহ আমাদের পূর্বপুরুষগণের উপাস্য দেবতার বিরুদ্ধে, যে-দেবতায় আমরা সকলেই বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি। এই প্রাচীন ক্ষমাহীন দেবতা আমাদের পিতৃভূমি। বিদ্রোহ ধূমায়িত হইতেছিল তাহারই রক্তসিক্ত বিগ্রহের বিরুদ্ধে।

এই গহ্বরের মধ্যে আমি নিজের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, আদর্শের আবেগে অধীর ইউরোপের বীর তরুণেরা কত বড় সাংঘাতিক ফাঁদে পা দিয়াছে, কতখানি সর্বনাশ্য দুর্বুদ্ধি তাহাদের আচ্ছন্ন করিয়াছে। আত্মোৎসর্গের মহিমা ও মৃত্যুর ক্ষুদ্রতার মধ্যে যে একটি বিরোধ রহিয়াছে— আমার অন্তরকে তাহা বিদ্ধ করিল সে-দিন যাহারা মরিতেছিল তাহাদের প্রতি অকপট শ্রদ্ধা এবং অপরদিকে যাহারা মারিতেচিলেন তাহাদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষের বিদ্রোহ— এই দুই বিপরীত আবেগে আমার মন তখন বিদীর্ণ হইতেছিল। মারিতেছিল যাহারা তাহাদের মধ্যে ছিল রণযন্ত্রের পরিচালক পাপাত্মারা, আর ছিল উভয়পক্ষের শিবিরের শয়তান বুদ্ধিজীবীর দল যাহারা রণাঙ্গণের পশ্চাতে নিরাপদ দূরত্ব হইতে যুদ্ধরত তরুণগণের মাথার উপর দিয়া পরস্পরের কটুকাটব্য নিক্ষেপ করিতে শুরু করিয়াছিল।
তখন মার্ন-এর যুদ্ধ চলিতেছে। এই অবস্থার মধ্যে (১১ই—১২ই সেপ্টেম্বর) আমি সংগ্রামের ঊর্ধ্বে রচনা করি এবং আমার জেনেভার পুরাতন বন্ধু পল সাইপেলকে পড়িয়া শুনাই।

আজ আবার ইহা পড়িতেছি, পড়িতেছি এই শ্রদ্ধাঞ্জলি সেই তরুণদের উদ্দেশ্যে—যাহাদের একদিন বলি দেওয়া হইয়াছিল এবং যাহারা শেষে আমাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের দৈন্য ও লঘুচিত্ততার শোধ তুলিয়াছিল। সেদিন যে মত ব্যক্ত করিয়াছিলাম, আজও আমি সেই মতই পোষণ করি। সেদিনের একটি কথাও আজ প্রত্যাহার করিব না। ১৮৮০ সাল হইতে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আমার কৈশোরকাল সামাজিক অহমিকা ও হীন সুবিধাবাদের কদর্য আবহাওয়ার মধ্যে অতিবাহিত হইয়াছে, পারিতে তখন গণপরিষদে ও সাহিত্যক্ষেত্রে দুর্ণীতির বন্যা চলিতেছে। আমার ছোট Aert-এর চেয়েও বেশি প্রাণবান, আত্মবলিদানের জন্য যাহারা ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে তাহাদের নিকট আমি নত হইতে পারি না।

(ক্রমশ)