শিল্পীর নবজন্ম

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর…

কিন্তু মার্ক হইতে এক বিষয়ে
আমার সুবিধা ছিল বেশি। আমার
পশ্চাতে ছিল দুঃখযন্ত্রণাদীর্ণ ষাট বছরের জীবন; আমার চামড়া ছিল শক্ত।


(৬)
মার্ক ও এনেকি তখনও পথ খুঁজিয়া ফিরিতেছে। ১৯২৫ সালের অক্টোবর হইতে ১৯২৬ সালের মে মাসের মধ্যে আমার ‘মাতা ও সন্তান, পুস্তকের রচণা কাল।

লা’ম আঁশাঁতে পুস্তকের শেষ পর্বকে কার্ল র্যা ডেক উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে আগেকার কয়েক পর্বে ‘‘আমি আমার নায়িকাকে একটি অন্ধ গলির মধ্যে প্রবেশ করাইয়াছি। আর ইহাও লেখেন যে, ‘‘কাহিনীটি লইয়া কোন পথে অগ্রসর হওয়া যায় তাহা লেখক নিজে জানিতেন না বলিয়াই গল্পর অগ্রগতির বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছে।’’ ইহা সম্পূর্ণ সত্য নহে, ‘মাতা ও পুত্র’ পুস্তকে মূল বক্তব্য হইতেছে সমস্ত সামাজিক মতবাদের ভিত্তি। এবং শুধু আমার নহে আমার সোভিয়েট বন্ধুদেরও বটে।

আজ সর্বপ্রকার সামাজিক অগ্রগতির প্রথম ও প্রধান সর্ত হইতেছে যুদ্ধের বিরোধিতা। সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মধ্যে গত দশ বৎসর ধরিয়া যে মৈত্রীবন্ধন গড়িয়া উঠিয়াছে তাহার মূলেও রহিয়াছে এই যুদ্ধবিরোধিতা। এবং এই মৈত্রীবন্ধনের ফলেই ১৯৩৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আম্স্টার্ডম আন্দোলনের সহায়তায় সোভিয়েট ইউনিয়ন রাষ্ট্রসঙ্ঘে যোগদান করে। অতএব এখানে কোনো কাণাগলির প্রশ্ন ছিল না, বরঞ্চ ছিল তাহার বিপরীত। কিন্তু সংগ্রাম ও সংঘর্ষ হইতে একটি বিরতি তখন আসিয়াছিল। বইএর শেষ কয় পাতার মধ্যে আনেৎ ও মার্কস এ-কথা ভালভাবেই বুঝিয়া ছিল যে এই বিরতি সাময়িক বিশ্রাম মাত্র। … আত্মোৎসর্গের পালা তখন শেষ হইয়াছে মার্ক ও আনেৎ জানিত ইহার জন্য তাহাদিগকে মূল্য দিতে হইবে, ১৯১৮ সালের নবেম্বর মাস হইতেই ‘মাতের দালেইরস’ পুত্রের শোক অগ্রিম বহন করিতে শুরু করিয়াছিলেন।
কিন্তু ঘাতকের খড়্গ যে কখন কোথায় নামিবে, শত্রু যে কে— তাহা তাহাদের কেহই তখনও দেখিতে পায় নাই। অবিলম্বে স্পষ্টভাবে শত্রুর রূপ চিনিবার অবস্থা তাহাদের ছিল না। তখনও তাহারা বুঝিতে পারে নাই কাহার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিতে হইবে, কাহার সহিত চূড়ান্ত সংঘর্ষে অবতীর্ণ হইতে হইবে। (কারণ, ‘মাতা ও পুত্রের’ এই পর্যায়ে সমগ্র ধনতান্ত্রিক জগতই শত্রু বলিয়া প্রতিভাত হয়। পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ ভাল লোকেই আজও এই পর্যায়ে রহিয়াছেন। কিন্তু এই শত্রুর শত্রুর আক্রমণের সম্মুখীন হইবার জন্য তাহারা নির্ভীকভাবে প্রস্তুত হইতেছেন, তথাপি তাহারা জানেন না আঘাত ঠিক কোথা হইতে আসিবে এবং শত্রু ঠিক কোন রূপ পরিগ্রহ করিবে)।

তখন (১৯২৫ ও ১৯২৬) ইতালীয় ফ্যাসিজম্-এর কল্যাণে শত্রুর চেহারা আমাদের চোখে পড়িতে শুরু করিয়াছে। ১৯৩৩ সালের ১০ই মে পর্যন্ত আমাদের আর দেরি করিতে হইল না, যদিও কার্ল র্যােকেড’এর মতে তখন হইতেই ‘মানবতা-ধর্মী’ লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তেনর প্রয়োজন দেখা দিয়াছে।

তাহার মতে ঐ দিনেই জার্মান ফ্যাশিস্টরা তাহাদের বই পোড়াইয়াছে এবং এই দাহকার্যে শ্রমিক পার্টির বইও পূর্বোক্ত লেখকদিগের বইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে নাই।

কিন্তু ফ্রান্সে আমরা আমাদের ইতালীয় ভ্রাতৃগণের অপমান ও নির্যাতনকে আরও বেশি অনুভব করিয়াছিলাম, এবং ইহা কার্ল র্যানডক নির্দিষ্ট তারিখ হইতে প্রায় ৮ বৎসর পূর্বে। আমাদের দুইটি জাতির মধ্যকার বন্ধন এত নিবিড় যে, একের উপর আঘাত আসিলে অবশ্য সর্বাঙ্গ কাঁপিয়া ওঠে। ব্যক্তিগতভাবে বলিতে গেলে যৌবনে ইতালী আমার মনের অনেকাংশে জুড়িয়া ছিল।

(ক্রমশ)