শিল্পীর নবজন্ম

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর…

এ প্রচেষ্টা আমারু ব্যর্থ হইয়াছে এবং এ ব্যর্থতায় আমি বিস্মিত হই নাই। এ ব্যর্থতা ছিল অবশ্যম্ভাবী, কারণ যে দুইটি মতবাদকে আমি মিলিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম তাহারা আপোশ জানিত না, প্রত্যেকটিই নিজেকে সত্যের একমাত্র ধারক ও বাহক হিসাবে মনে করিত এবং অপর মতবাদের মধ্যকার সত্যকে শত্রু বিবেচনা করিত। আমি কিন্তু একটি বিশেষ মতবাদ দৃঢ়ভাবে পোষণ করিয়াও ছিলাম একজন ইউরোপীয় অবিশ্বাসী।
আমাদের অঞ্চলে একটা সাধারণ প্রবচন আছে, ‘যে সন্দেহ করে সে কখনও মরে না’। কাঁচা ফলের আস্বাদের মত যেমন কষায় তেমনি চমৎকার এই কথাটি। কোনো শক্তিশালী সামাজিক বা ধর্মগত মতবাদকে আমি কোনোদিন অন্ধ বিশ্বাসের অচলায়তন হিসাবে দেখি নাই, দেখিয়াছি মানুষের অগ্রগতির পথনির্দেশকারী মৌলিক বিধান হিসাবে। গান্ধীপন্থী ভারতবর্ষের ও সোভিয়েট ইউনিয়নের দুইটি মতবাদ ছিল আমার কাছে দুইটি পরীক্ষা দুইটি বৃহত্তম, প্রবলতম পরীক্ষা— যে দুইটি পরীক্ষা আসন্ন ধ্বংসের মুখ হইতে মানুষের পৃথিবীকে টানিয়া আনিতে পারে। গান্ধী নিজে ইহা স্বীকার করিয়াছিলেন। আমি ইহাও ভাবিয়া দেখিয়াছিলাম এই দুই মতবাদের সমবেত শক্তি ধ্বংসের হাত হইতে পৃথিবীকে বাঁচাইবার পক্ষে খুব বেশি হইবে না। অতএব, পরস্পরকে ধ্বংস না করিয়া সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে তাহারা কি সম্মিলিত হইতে পারিত না? এই মিলনের চেষ্টায় আমি ব্যর্থ হইয়াছিলাম সত্য, কিন্তু এই চেষ্টা করিয়াছিলাম বলিয়া আমি দুঃখিত নই। গান্ধী সম্পর্কিত পুস্তকখানির রচনা যখন আমার কেবল শেষ হইয়াছে তখন লেনিনের মৃত্যু (১৯২৪ সালের ২১শে জানুয়ারী) গভীর শোক ও সম্ভ্রমে আমাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিল।


তাহার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমি দুইটি শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠাইলাম ইজভেস্তিয়া পত্রিকায়। একটি টেলিগ্রাম করিয়া, অপরটি চিঠিতে। বোলশেভিকদের বিরুদ্ধে সোস্যাল-রিভলিউশানারীদের পক্ষ লইয়া ইতিপূর্বে একাধিকবার আমি লড়িয়াছি (বিশেষত ‘‘রুশ বিপ্লবের পিতামহী’’ ক্যাথারিন ব্রেস্কোভ্স্কায়ার নিকট হইতে একটি আবেদন পাইবার পর), এই ভ্রাতৃঘাতী সংগ্রামের ফল যে কত শোচনীয় হইতে পারে ইতিপূর্বে একাধিকবার তাহাও জানাইয়াছি। তারপর ১৯২৫ সালে পোল্যাণ্ড, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়ায় ‘হোয়াইট’দের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমি যোগ দিই সেকুর রুজ অ্যাঁতেরনাসিয়নাল-এর সহিত! এ প্রতিবাদ ‘সমস্ত অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সমস্ত অত্যাচারিতদের পক্ষ সমর্থন। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে S. R. I.-এর সেক্রেটারীর জন্য আমি ঐ স্লোগানটিই লিখিয়া পাঠাই।

চিন্তার ও সামাজিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক স্বাধীনতাকে রক্ষা করাই ছিল এই অভিযানের মূল কর্তব্য। মস্কোর State Academy of Sciences & Arts হইতে প্রেরিত একটি ভাষণের দীর্ঘ জবাবে আমি এই কর্তব্যেরই ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিঃ

‘‘সত্যকার বিপ্লবী মনোবৃত্তি বলিতে আমি তাহাকেই বুঝি যাহা জীবনের বিভিন্ন রূপকে জমাট বাঁধিতে দেয় না অথবা এই সব রূপের মধ্যে জীবনের ধারাস্রোতকে রুদ্ধ হইতে দেয় না। সত্যকার বিপ্লবী মনোবৃত্তি কখনও সামাজিক মিথ্যাচারকে সহ্য করে না। যে সমাজ ধ্বংস করিয়া সে গড়িয়া উঠিয়াছে সেই সমাজেরই ধ্বংসস্তুপের উপর নূতন সমাজ যে অন্ধ সংস্কার প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে তাহার বিরুদ্ধে এই বিপ্লবী মনোবৃত্তির সংগ্রাম চলে চিরদিন। যেমন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পুরাতন সংস্কারের বিরুদ্ধে তাহার যুদ্ধ তেমনই শ্রমিকবিপ্লবের নূতন সংস্কারের বিরুদ্ধেও সে অস্ত্র ধারণ করে। কোনো কিছুকেই ইহা পরম পবিত্রজ্ঞানে অন্ধভাবে গ্রহণ করে না।

(ক্রমশ)