শিল্পীর নবজন্ম

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর

তাহা না গিয়া সে ফরাসী সুইজারল্যাণ্ডে তাহার পত্রিকাখানিকে রুশবিপ্লবের মুখপত্র করিয়া তোলে। লেনিন, স্ট্রটস্কি, ক্যামেনেভ, রাকোভস্কি, রাডেক, কালোনিন, জিনোভিয়েভ, লুনাচারস্কি অর্থাৎ পুরাতন পৃথিবী ভাঙ্গিয়া নূতন গড়িবার যুদ্ধের সমগ্র সামরিক নেতৃমণ্ডলীর সদস্যদের নাম আমার প্রায়ই এই পত্রিকাখানিতে চোখে পড়িত। রুশ বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবীদের সে সমর্থন করিত দুঃসাহসের সহিত। কিন্তু তাহার পত্রিকাখানির মত রুশ বিপ্লবের ঘটনামালার এত ভাল ইতিহাস ফরাসী ভাষায় আর নাই।


আমি তাহার সঙ্গে ছিলাম শুধু নিরপেক্ষ দর্শক হিসাবেই। বিপ্লবের বীরগণের মহত্ব ও তাহাদের আদর্শের উচ্চতার প্রতি আমার সহানুভূতি ছিল বটে, কিন্তু তাহাদের হিংসাত্মক রক্তপাতের পথ আমাকে কেবলই দূরে ঠেলিত। আমি কর্মী ছিলাম; আমার কাজ ছিল চিন্তা। আমি ভাবিতাম ইউরোপের চিন্তাধারাকে পরিচ্ছন্ন, পবিত্র, স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ রাখিবার চেষ্টা করাই আমার কর্তব্য। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে লেনিন আমাকে সঙ্গে করিয়া রাশিয়ায় লইয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন এবং গিলবো-র মারফৎ সংবাদ পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হই নাই।

মানসিক বিবর্তনের যে স্তরে তখন আমি পৌঁছিয়াছি তখন বিপ্লবকে আমি ভুল করিয়া একাধিক রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষ বলিয়া ভাবিতাম, সেইজন্য চিন্তাজগতের প্রহরীর স্থান ত্যাগ করিয়া যাইতে আমি রাজি হই নাই। আজ আর আমার ওভাবে ভাবা চলে না। আজিকার মত সেদিন তখনও বুর্জোয়া ভাবাদর্শের, এমন কি শ্রেষ্ঠ বুর্জোয়া ভাবাদর্শের, অভ্যন্তরটা এমনভাবে চোখে পড়ে নাই। ‘বুদ্ধিজীবীর কুলনী গোষ্ঠী’ নামক (এমন কি যখন আন্তর্জাতিক’ নামে তাহারা জাহির করে তখনও) অদ্ভূত জীবের ভিতরটা তখনও আজিকার মত পড়িতে পারি নাই। যে চরিত্রবল, নাগরিক সৎসাহস ও চিন্তার বলিষ্ঠতা ঐ গোষ্ঠীর আছে বলিয়া আমার ধারণা ছিল, দেখিলাম তাহার কিছুই নাই। ইহারা মুখে সত্যের বড় বড় বুলি আওড়ায়, এই বুলিতে নিজেদের ঢাকিয়া রাখে।

বাস্তবক্ষেত্রে সত্যকে ইহারা ভয় পায়। সত্যকে ইহারা নিজেদের কাজে লাগায়। ইহারা এতদূর যায় যে, সত্যকে সাহিত্যিক প্রসাধন হিসাবে, আর্টের অখরের কৃত্তিম রঞ্জনী হিসাবে ব্যবহার করিতেও ইহাদের বাধে না। এইভাবে ইহারা নিজেদের জাহির করে। লেখকদের মধ্যে সৌন্দর্যের উপাসক যিনি সবচেয়ে বেশি, তিনি রাস্তায় জনসাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিবার জন্য সত্যকে পণ্যা নারীর মত ব্যবহার করেন।

যদিও জাঁ ক্রিস্তফের সঙ্গে আমিও বহু পূর্বেই সত্যের এই সকল গণিকা ও দালালদের আবর্জনাস্তূপে নিক্ষেপ করিয়াছিলাম, তথাপি আরো কত দেখিবার বাকী থাকিল তাহা তখনও বুঝিতে পারি নাই—বুঝিতে চাহি নাই। ইহার পরেও আমি আশা করিয়াছিলাম ইউরোপের মনস্বীগোষ্ঠীর মধ্য হইতে ছোট অথচ দুঃসাহসী, আদর্শনিষ্ঠ, সংকল্পবদ্ধ একটি উপদলের অভ্যুত্থান দেখিতে পাইব এবং ইহারাই চিন্তার স্বাধীনতাকে প্রাণ দিয়া রক্ষা করিবে, প্রেক্যুরস্যের পুস্তকের শেষ প্রবন্ধগুলি ইহাদেরই লক্ষ্য করিয়া লেখা। ইহাদেরই একত্রিত, দলবদ্ধ করিবার জন্য, ১৯১৯ সালের বসন্তকালের ‘ঘোষণাবাণীটি’ পুস্তকের সর্বশেষে সন্নিবেশ করি। সমগ্র জগতের শত শত শ্রেষ্ঠ চিন্তাবীরের স্বাক্ষর ইহাতে রহিয়াছে।

কিন্তু লক্ষ্য করিতে হইবে যে, এই আবেদনটির রচনা করিতে বসিয়া আমার চিন্তা বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীকে ছাড়াইয়া গিয়াছে, ‘বিশ্বজনগণের’ সেবায় তাহাদের নিয়োগ করিতে চাহিয়াছে— যে বিশ্বজনগণ ‘দুঃখ ভোগ করে, সংগ্রাম করে, পরাজিত হয়, আবার ওঠে, আবার রক্তসিক্ত প্রগতির কঠিন পথ বাহিয়া যাত্রা শুরু করে।’

(ক্রমশ)