শিল্পীর নবজন্ম

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর…

সাউথ আফ্রিকায় গান্ধীজীর ঐতিহাসিক সংগ্রামে ইহারা ছিলেন তার দুইজন সহকর্মী। আমার সহিত দেখা হইবার কিছুদিন পরেই শোচনীয়ভাবে পিয়ার্সনের জীবনাবসান হয়। ইহাদের দেখিয়া আসার যীশু খ্রীষ্টের প্রথম প্রচারকদের কথা মনে পড়ে। সেই বলিষ্ঠ সহজ প্রশান্তি ইহাদের মধ্যে আমি দেখিতে পাই। এই সময় একজন মহিলা আমার সহিদ দেখা করিতে আসেন, ইহারক নাম মিস ফ্যাডেলা ইনস্লেড, ইনি একজন ইংরেজ এডমিরালের কন্য। না জানিয়া যে গুরুকে তিনি খুঁজিয়া বেড়াইতেছিলেন তাহার সন্ধান আমি তাহাকে বলিয়া দিই। ইনিই পরবর্তীকালে গান্ধীজীর মার্থা ও মেরী হন।


রবীন্দ্রনাথ ও স্যার জগদীশচন্দ্রের, বন্ধুত্ব; কালীদাস নাগ ও লাজপত রায়ের সহিত সাক্ষাৎকার, ভারতবর্ষের সহিত প্রচুর পত্রবিনিময় এবং বাংলাদেশের পত্রিকাগুলি পাঠ করিবার ফলে আমি ভারতীয় মনে আরও গভীরভাবে প্রবেশ করিলাম। সে মনের সহিত আমার মনের কোনো কোনো বিষয়ে গভীর সাদৃশ্য দেখিয়া আমার বিস্ময়ের সীমা রহিল না।

আমার ভাবজগতের এমন অনেক রহস্যলোক ছিল যাহাদের এতদিন ভাবিয়া আসিয়াছি কেবলমাত্র ফরাসী চিন্তাজগতেরই জিনিস; সেদিন দেখিলাম ভারতবর্ষেও উহার দোসর মেলে; পরে আমার রামকৃষ্ণের জীবন চরিতের ভূমিকায় আমি এই আবিষ্ক্রিয়ার কথা উল্লেখ করিয়াছি। অবশেষে জেল হইতে বাহিরে আসিয়া ১৯২৪ সালের ২২শে মার্চ তারিখে গান্ধী আমার নিকট যে প্রথম পত্র লেখেন তাহাই আমাদের বন্ধুত্বের পূর্ব সূচনা। মারাত্মক ব্যাধি হইতে উঠিয়া তিনি তখন আরোগ্যের পথে। তখন হইতে কয়েক বৎসর আমি ইউরোপে গান্ধীর ভাবাদর্শের মুখপাত্র হইলাম। গান্ধীর প্রবন্ধ সংকলন ইয়ং ইণ্ডিয়ার (জুলাই, ১৯২৪) ফরাসী সংস্করণের যে ভূমিকা আমি লিখিয়া দিই তাহার মধ্য দিয়া ইউরোপের সমাজসংগ্রামের সহিত গান্ধীজীর ভাবাদর্শকে সহযুক্ত করিতে চেষ্টা করিতেছিলাম।

কিন্তু এই সকল ব্যাপারের মধ্যেও রশি বিপ্লবের আদর্শকে এবং সংগ্রামে নিমগ্ন থাকিয়াও নূতন জগত সৃষ্টির এই অতিমানবীয় প্রচেষ্টাকে আমি কখনও দ্বিতীয় আসন দিই নাই। ভারতের সহিত মক্সোর, আগুনের সহিত জলের মিলন সাধনের আপাত বিপরীত কাজে আমি আত্মনিয়োগ করিলাম। ইয়ং ইণ্ডিয়ার ভূমিকাতেও আমি লিখিলামঃ ‘‘আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা ও বিপ্লবীদের হিংসার মধ্যে দূরত্ব ততটা নহে যতটা বীরের মত অহিংস প্রতিরোধ এবং চিরন্তন যো-হুকুম-দারের কৃতদাসসুলভ মনোভাবের মধ্যে। এই মনোভাবই প্রত্যেক অত্যাচারী শাসকের দুর্গস্তম্ভ রচনা করে, সর্বপ্রকার প্রতিক্রিয়াকে কায়েমী করিয়া রাখে।’’

গান্ধীর আদর্শকে কেহ যে কাপুরুষ ক্লীবের শািস্তবাদিতার সহিত এক করিয়া দেখিবে ইহা আমি কিছুতেই সহ্য করিতে পারিতাম না। আমি সর্বদা তাহার ‘সংগ্রামশীলতার’ উপর জোর দিতাম, জোর দিতাম গান্ধীজী কর্তৃক বারম্বার ‘তরবারি’ কথাটি ব্যবহারের উপর। ইহা তাহার মতে ইস্পাতের তরবারি নয়, তরবারির বিরুদ্ধে তরবারির প্রয়োগ নয়। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী জানিয়া সত্যের জন ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে আত্মদানের মহান অস্ত্র হিসাবেই গান্ধী ‘তরবারী’ কথাটি ব্যবহার করিতেন। যুদ্ধের দুই বৎসর পূর্বে জাঁ ক্রিস্তফ পুস্তকের শেষে ফ্রান্সে ও জার্মানীকে মিলিত হইবার আহ্বান জানাইয়া লিখিয়াছিলেন, ‘‘তাহারা যেন পাশ্চাত্যের দুইটি ডানা। একটি ভাঙ্গিয়া গেলে আরেকটিও অচল হইয়া পড়িবে।’’ ঠিক তেমনইভাবে সোভিয়েট ইউনিয়নের সংগ্রামশীল সাম্যবাদ এবং গান্ধীর নেতৃত্বে সংগঠিত ও পরিচালিত অহিংস অবাধ্যতা (আইন অমান্য আন্দোলন) একই বিপ্লবের দুইটি বিরাট ডানা হিসাবেই আমি দেখিতে চাহিয়াছিলাম। আমি চাহিয়াছিলাম ডানা দুইটি যেন পরস্পরের সহিত সহযোগ ও সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া একই স্পন্দনে স্পন্দিত হইতে পারে।

(ক্রমশ)