রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
রাইন নদীর তীরে তখন গত দশ দিন ধরিয়া মহাযুদ্ধের যে তীব্রতম সংগাম চলিতেছিল তাহার উন্মাদনায় আমার এই আবেদন নিঃশব্দ বিস্মৃতির তলে মিলাইয়া গেল। তখন র্যাঁ স নগরে আগুন জ্বলিতেছে; সেই আগুনের মধ্য হইতে নিবিড় ঘৃণার যে বিষাক্ত ধুম বাহির হইয়া আসিতেছিল তাহার মধ্যে আমার মিনতি ঢাকা পড়িয়া গেল। সে মিনতি ফ্রান্সের কানে পৌঁছিল পুরা একটি মাস পরে; ফ্রান্স তখন আর সে ফ্রান্স নাই।
আর একটি জিনিস প্রথম দুইমাস আমাকে হতাশার হাত হইতে রক্ষা করিয়াছিল। জার্মান সাহিত্যে ও পুস্তকে যে অবিশ্বাস, বিকারের প্রলাপ প্রকাশিত হইতেছিল তাহার তুলনায় ফ্রান্সের প্রকাশিত রচনা অনেকটা সংযত ছিল।
সর্বোপরি আর একটি জিনিস হইল (ইহাকে বিশ্বাস বলিব কি আশা বলিব জানি না, কারণ বিশ্বাসের উৎস তখন শুকাইয়া গিয়াছে, সে জিনিসটি হইতেছে এই যে, রাশিয়াকে বাদ দিলে যে সব চেয়ে বড় শয়তান সে মিত্রশক্তিপুঞ্জের পক্ষে ছিল না।
শীঘ্রই আমার এ মোহ ভাঙ্গিল।
যে কদর ঘৃণাকে সাহিত্যিকেরা, ধুমায়িত করিয়া তুলিতেছিলেন, অথচ যাহাতে তাহাদের নিজেদের কোনো বিপদ ছিল না, তাহা ফ্রান্সের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্র-জগতকে বিপুলবেগে সংক্রামিত করিয়া প্রায় সমগ্র জাতি ও তাহার ভাবধারাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। প্রথম আমি ভাবিয়াছিলাম ইহা বোধ হয় সাময়িক বিভ্রান্তি মাত্র। প্রথম এবং সর্বাপেক্ষা সাংঘাতিক বিপদ যতই উঠিতে লাগিল। মৃত্যুর হাত হইতে সদ্য রক্ষা পাওয়া ভয়ার্ত পশু যেন তাহার প্রতিশোধ নিতেছিল। দেশের উপর দিয়া যে ঝড় বহিয়া যাইতেছিল, তাহার হিংস্রতা সম্পর্কে মোহমুক্ত মনের কিছু তিক্ত অভিমত ২০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমি ব্যক্ত করিয়াছিলাম। ‘‘বর্তমানে মানুষের সত্যকার মাপকাঠি কি হইবে’’ সে সম্পর্কেও লিখিয়াছিলাম। যাহাদিগকে সব চেয়ে বেশি জানি মনে করিতাম তাহাদের প্রকৃতরূপ এই সংকটে চোখে প্রতিভাত হইয়াছে। মুখোশ খসিয়া পড়িয়াছে; যেখানে দেখিব ভাবিয়াছিলাম প্রিয় বন্ধুর স্নেহসিক্ত মুখচ্ছবি সেখানে দেখিলাম বাচ্চা নেকড়ের ফ্যানাসিক্ত দাঁত।’’
কিন্তু বাচ্চা নেকড়ের চেয়ে বুড়ো নেকরে আরও বেশি সাংঘাতিক। এই বুড়ো নেকড়ে-দলের দলপতি ছিলেন বারেস। আর ভয়ে দিশেহারা হইয়া আনাতোল ফ্রাস তাহার সত্তর বছরের বার্ধক্যজীর্ণ কণ্ঠে অন্য সকলের সহিত চীৎকার জুড়িয়া দিলেন; তিনি চীৎকার জুড়িয়া দিলেন কারণ সৈন্যদলে তাহাকে লইত না (২৮শেষ সেপ্টেম্বর)।
ইউরোপ হইতে আর কিছু আমি আশা করিলাম না। ‘‘সমস্ত ইউরোপটা যেন একটা উন্মাদ আশ্রম। এখানে প্রত্যেকেই যেন নিজেকে জগতপিতা ভগবান মনে করিতেছে।’’ (ডায়েরী ২৮শে সেপ্টেম্বর)
১লা অক্টোবর তারিখ, অর্থাৎ অন্য সকলের চেয়ে চার বছর আগে যুদ্ধরত দেশগুলির বাহিরে একজন বিরোধ-নিষ্পত্তিকারীর অনুসন্ধান করিয়া প্রেসিডেন্ট উইলসনকে আমি লিখিয়াছিলাম, ‘‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট এই ভয়াবহ যুদ্ধের লক্ষ্য যাহাই হোক না কেন, পরিণতি যে ইউরোপের ধ্বংসে তাহাতে সন্ধেহ নাই।
(ক্রমশ)