শিল্পীর নবজন্ম

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর

সেই অন্ধকারে পথ খুঁজিতে আমার সময় লাগিল। আর কাহাকেও যে পথ দেখাইতে পারি সে কথা তখন চিন্তাও করি নাই। সে কাজ আমার নহে। আমি কি? আমি তখন একজন কবি ও সংগীতকার, যাহার ধ্যানের প্রাঙ্গনে মাঝে মাঝে ভবিষ্যত দুর্দিনের দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে মাত্র। (বিশ বৎসর পূর্ণ হইবার পূর্বেই ইউরোপের ভীষণ দুর্দিনের পদধ্বনি আমার কানে আসিয়াছে, প্রথমজীবনে লিখিত আমার একাধিক নাটিকায় ইহার সাক্ষ্য আছে)।


কিন্তু এ পর্যন্ত রাজনীতি আমি স্পর্শ করি নাই। আমার মানসপুত্র, ত্রিশ বৎসরের আমি, জ্যাঁ ক্রিস্তফ আমার ইচ্ছার অপেক্ষা না রাখিয়াই আমার নামকে করিয়া তুলিল একটি সম্মেলনক্ষেত্র, পর্বতচূড়ায় একটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা (জ্বলন্ত হইলেও যাহা ধূমবিহীন নহে); নৈতিক জীবনের পরিচালক ও সঙ্গী কোনো জেষ্ঠ্য ভ্রাতার মত আমার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল ফ্রান্সের তরুণগণ। কিন্তু যেখানে সমাজসংগ্রামে কর্মের প্রসঙ্গ আসিয়াছে, নির্দেশের জন্য আমি আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তির মুখের দিকে তাকাইয়াছি, তাকাইয়াছি সোশিয়ালিস্ট নেতাগণের মুখের দিকে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আমার বিশেষ শ্রদ্ধেয় বন্ধু। আনাতোল ফ্রাঁস ও অক্টাভ মিরাবোর মত সংস্কারমুক্ত বুদ্ধিজীবীদের দিকেও তাকাইয়াছি। দীর্ঘ অন্তর্দ্বন্দ্বের পর তাহারা প্রবল প্রতিক্রিয়াবন্যার বিরুদ্ধে অভিযান চালাইয়াছিলেন। নির্দেশের জন্য গিয়াছি শিক্ষালয়ের পণ্ডিতদের নিকট, গিয়াছি আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মীদের কাছে, যাহাদিগকে একল নর্মাল স্যুপেরিয়োর ও সরবন-এ প্রথমে ছাত্র হিসাবে ও পরে অধ্যাপক হিসাবে নিবিড়ভাবে জানিবার আমার সুযোগ হইয়াছিল। ইহাদের স্বচ্ছ ধীশক্তি, যুক্তিনিষ্ট সমালোচনাপদ্ধতি ও সত্যানুরাগ দেখিয়া বুঝিয়াছিলাম ইহাদেরই আছে মনের স্বাধীনতা ও অলংকিত বিচারবুদ্ধি।

অন্ধকারে দিশাহারা আমি তখন অধীর প্রতীক্ষায় দিন গুণিতে লাগিলাম, কখন তাহাদের কণ্ঠস্বর শুনিবঃ ‘‘এই পথে…’’ আসিল না এই নির্দেশবাণী, আসিল শুধু রণাঙ্গনগামী সেনাবাহিনীর পদশব্দ, আর আসিল আরামকেদারাশায়ী বীরগণের অর্থহীন নির্বোধ গানঃ ‘‘আলে, আঁফাঁ দ্য লা পাত্রি’’ সকলেই তখন তাহাদের নিজ নিজ স্থান ত্যাগ করিয়া গিয়াছে; জোরে যুদ্ধে নিহত হইয়াছেন।

আমি একেবারে নিঃসঙ্গ হইলাম। আগস্টের প্রথম কয়েক বৎসর নিজের সহিত কথোপকথন চালাইলাম, নানাভাবে প্রশ্ন করিলাম বিবেককে, করিলাম ঈশ্বরের মধ্যে আত্মগোপন। বাধ্য হইয়া স্বীকার করিতে হইল পিতৃভূমি ও মানবসমাজ আমাদের এই দুই দেবতার একটি অপরটিকে গিলিয়া খাইয়াছে। যেটি রহিয়াছে সেটিকেও লোকে ভুলিয়া যাইতেছে।

এই একক দেবতায় বিশ্বাস অটুট রহিল কি কেবলমাত্র আমারই! কাল পর্যন্ত যাহাদের বিশ্বাস অটুট ছিল তাহাদেরও কেহ যখন কোনো কথা কহিলেন না তখন আমার কি বলা উচিত হইবে? কীই বা আমি বলিব? বলিবার কি অধিকারই বা আমার আছে? কেই বা আমার কথা শুনিবে? রণাঙ্গন হইতে বন্ধুগণের প্রথম পত্র আসিতে শুরু করিল। উৎসাহের আর অন্ত নাই; ফরাসী কলিতে বিশ্বাস তাহাদের তখন উদ্দীপ্ত করিয়া তুলিয়াছে। সে কলির হাজার মাথা, অতীতের পিতৃভূমি, ভবিষ্যতের পিতৃভূমি,

(ক্রমশ)