রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
দুই দেবতা আমাদের কাছে তখন অভিন্ন। জাঁ ক্রিস্তফ ও পেগি তখন কর্মের এক অতীন্দ্রিয় ভাবাবেগে অধীর; এমন এক বীর ধর্মে তাহারা আত্মহারা, যাহার আবেগে যে কোনো বিশ্বাসের পদমূলে জীবন সঁপিয়া দিয়া, সর্বস্ব বলিয়া দিয়া মানুষ শান্ত হয়।
সেদিনের সেই নেশায় যাহারা পাগল হইয়াছিলেন এবং যাহারা সে ভাবসুরাপানকে কখনো অস্বীকার করেন না, তাহাদেরই একজন জঁ রিশার ব্লক। তাহার সম্প্রতি প্রকাশিত দেস্ত্যাঁ দ্যু সিয়েক্ল পুস্তকে লিখিতেছেন (১৯৩১):
‘‘আমাদের সমগ্র যৌবন কাটিয়াছিল একটি মাত্র কথার নেশায়: সেবা। এই কথাটিই ছিল আমাদের জীবনবেদের মূলবাণী, আমাদের সম্মেলন মন্ত্র।… টলস্টয়ের সমগ্র মানসজীবনকে অভিভূত করিয়াছিল এই একটি কথা। … পেগির সহিত জ্যাঁ ক্রিস্তফ এবং দেইফ্যুস সংকটযুগের অতীন্দ্রিয় ভাবাবেগ এ-সকল মিলিয়া আমাদের চারিপাশে মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও নির্ভিক কর্তব্যের এক দুর্গ গড়িয়া তুলিয়াছিল। আমাদের ছিল স্বেচ্ছায় সেবার আদর্শ।
আর এই আদর্শকে অনুসরণ করিয়াই আমরা ১৯১৪ সালের সংকটে স্বেচ্ছায় যোগদান করিয়াছিলাম— ‘আমাদের আদর্শের ইহাই হইল সব চেয়ে শোচনীয় পরিণতি।’ জাঁ রিশার লিখিতেছেন: ‘‘আত্মদানের এই অতি আসক্তির হাত হইতে আমি ছাড়া আর বিশেষ কেউ নিষ্কৃতি পায় নাই, কারণ আমি ছিলাম সকলের চেয়ে বেশি টলস্টয়পন্থী; তাই আমি আবিষ্কার করিয়াছিলাম, এই সেবা-দাসত্বের পরপারে ধর্মাসক্ত বিবেকের স্বাধীন, স্বতন্ত্র গভীর নির্জনতা।’’ জঁ রিশার হয় ত’ বুঝিতে পারিবেন কী গভীর দুশ্চিন্তা লইয়া আমি দেখিতেছিলাম, যে স্রোতস্বিনীর মধ্যে আমার বন্ধুরা ও ছোট ভাইয়েরা ডুবিয়া যাইতেছে। তবে কি তাহারা তাহাকে অনুসরণ করে নাই!
অনুসরণ তাহারা ঠিকই করিয়াছিল। কিন্তু পরপার হইতে অনুসরণকারীদিগকে স্রোত উত্তরণে সাহায্য করিবার মত সময় ক্রিস্তফের ছিল না।…
আমার নিকট আমার এই বন্ধুদের একজনের মায়ের লেখা একখানি চিঠি (১৯১৪ সালের ২৫শে আগস্ট তারিখে লেখা) এখানে আমি উদ্ধৃত করিতেছি। বন্ধুটি বাইশ-তেইশ বছরের যুবক—নিষ্কলুষ, হৃদয়বান, প্রাণাবেগে পূর্ণ।
যুদ্ধের প্রথমদিকে লোরেনের একটি সংঘর্ষে ইনি নিহত হন। চিঠিখানি এই:
‘‘আমাদের একমাত্র পুত্র, জার্মান বুলেটে নিহত হইয়াছে। যুদ্ধে যাইবার পূর্বে সে প্রায়ই আপনার কাছে চিঠি লিখিবার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করিত।
(ক্রমশ)