রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর…
আঁদ্রে মালারো শিল্প ও সোভিয়েট সভ্যতা সম্পর্কে তাহার চমৎকার বক্তৃতায় এই কথাই বলিয়াছেন (অক্টোবর, ১৯৩৪)।
কিন্তু তিনি বলেন এই মানবয়ীতার (Humanism) সূচনা নূতন যুগ হইতে, এবং পূর্ববর্তী যুগে ইহা ছিল বলিয়া তিনি স্বীকার করিতে চাহেন না। পূর্ববর্তী যুগ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ঐ যুগে মানুষ ‘নিজের সভ্যতাকে অস্বীকার’ করিয়াছে। এইখানেই তিনি ঐতিহাসিক বিবর্তনকে খুব বেশি সহজভাবে বা খুব বেশি বড়ভাবে দেখিতেছেন। আমার মনে হয়, মানবতার একমাত্র ধারক ও বাহক বলিয়া পূর্ববর্তী যুগ উদ্ধত দাবী জানাইয়াছে বলিয়াই মালরো তাহাকে মানবীয়তা হইতে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করিয়া তাহার উপর প্রতিশোধ লইয়াছেন। সত্যকার মানবয়ীতা যদি পরিপূর্ণ, সচেতন ও সভ্য মানুষের সন্ধান হয়, যদি উহাতে সবার সহিত একের মিলনের উৎকণ্ঠো তাহাকে মানবীয়তা হইতে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করিয়া তাহার উপর প্রতিশোধ লইয়াছেন। সত্যকার মানবয়ীতা যদি পরিপূর্ণ, সচেতন ও সভ্য মানুষের সন্ধান হয়, যদি উহাতে সবার সহিত একের মিলনের উৎকণ্ঠা ব্যক্ত হয়, তবে মানবীয়তাই ছিল অতীতের চিন্তানায়কগণের মূল সুর। ‘Ode to Joy’ ও ‘Ninth Symphony’র মধ্যে ‘মানুষের মিলনের মহিমা’র ও ভ্রাতৃত্বের তীব্র উপলব্ধির যে বাণী শোনা যাইতেছে, য দুই মহাচেতনার অভ্যুদয়কে মালরো আাজ স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছেন তাহা উপলব্ধির জন্য শীলারের সহিত বিটোফেন ত নবযুগের অভ্যুদয়ের জন্য বসিয়া ছিলেন না।
আজ যে সকল মহান শিল্পী নবযুগকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছেন তাহারা তাহাদের পূর্বাচার্যগণের মত প্রভাতের পূর্বেই দিনের আবির্ভাবকে ঘোষণা করিতেছেন না। আজ অবশেষে তাহাদের আহ্বানে সেইদিন সমাগত। আজ আর্টের আদর্শ ও সমাজসংগ্রামের মধ্যে মিলনের ধ্যানদৃষ্টি নহে; সে স্বপ্নে আজ বাস্তবের ঠাসবুনানি। বাস্তব জগতেই সে স্বপ্ন আজ রূপ পরিগ্রহ করিতেছে। মানুষের মনে আজ এক সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব অনুভূতি জাগিয়াছে— নিরাপত্তার অনুভূতি, আজ তার আগের মত মানুষ জলের উপরে হাটে না।
ভগ্নার যখন তার ‘ত্রিস্তান’ লেখেন তখন ইউরোপে কেহ উহা শুনিবার ও বুঝিবার নাই বলিয়া হতাশায় তিনি নাকি উহা রিও ডিজানিরোর এক কাল্পনিক শ্রোতৃমণ্ডলীর জন্য লিখিয়াছিলেন। আগামী যুগের উপযোগী আর্ট সৃষ্ট করিয়া প্রতিভাবান আর্টিস্টগণকে সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ মানুষের এমন ছবি মনের মধ্যে আনিতে হইয়াছিল যাহারা তাহার আর্ট বুঝিতে পারিবে। আজ তাহাদের ভবিষ্যদদৃষ্টির সেই শ্রোতৃ-সাধারণ সমুপন্থিত। আামরা আজ আর একা নই। আমরা একসঙ্গে কতা কহিয়া চলিয়াছি। যদিও সমাজের বর্তমান স্তরকে আঘাত দিয়া একটু আগাইয়া দেওয়া, আগামীদিনের বাস্তব সম্পর্কে স্বপ্ন আনিয়া দেওয়া মহান শিল্পীর চিরদিনের কর্তব্য থাকিবে, তথাপি তাহার স্থান অন্যান্য মজুরের মধ্যেই। আজ তাহারা সকলেই একসাথে একই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করিতেছে। আগে যাহারা উপাসনা মন্দির নির্মাণ করিত তাহারা খাটিত।
আজ আমাদের চোখের আচ্ছাদন খুলিয়া গিয়াছে. যে স্বাধীন শক্তিনিচয়ের মুক্তির জন্য আমরা অন্ধের মত এতকাল ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি, এক সমাজতান্ত্রিক সমাজে আজ তাহার সুস্থ ও সম্পূর্ণ বিকাশ শুরু হইয়াছে।
(ক্রমশ)