রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর…
বুর্জোয়া ভাবাদর্শের মর্মস্থলকে নির্মম স্বচ্ছতার সহিত কার্ল মার্কস্ উন্মোচন করিয়া দেখাইয়াছেন। আমাদের কাছে তাহার প্রতিভার এইটাই সবচেয়ে বড় কথা। যে মোহজালে আমরা নিজেদের আচ্ছন্ন হইতে দিয়াছিলাম তাহা তিনি ছিঁড়িয়া দিয়াছিলেন, আমাদের ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ করিবার বিপদ বরণ করিয়াও তিনি আমাদের মুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন।
‘‘গণতান্ত্রিক আইনের তালিকা লিপি’’ (Tablet of the Democratic Law) এবং ‘‘মানুষের স্বাধীনতা’’ (Rights of Man) এই দুইটি বাণীর মধ্যে কতখানি সত্যকার স্বাধীনতা আছে, ব্যক্তিমানুষকে ঐগুলি যে কত সংকীর্ণ সীমায় আবদ্ধ করিয়া রাখে তাহা মার্ক্সের মত এতখানি চোখে আঙ্গুল দিয়া আমাদের আর কেহ দেখাইয়া দেয় নাই।
‘‘কি লইয়া তাহাদের এই স্বাধীনতা? ছয় নম্বর বিষয় বস্তুঃ ‘অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ না করিয়া যাহা খুশি করিবার ক্ষমতাই স্বাধীনতা’ অথবা ১৯৭১ সালের ঘোষণা বাণী অনুসারে; অপরে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এমন সব কিছু করিবার ক্ষমতাই স্বাধীনতা’ ইহাতে অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত না করিয়া মানুষের বিচরণের ক্ষেত্রকে বেড়া দিয়া ঘেরিয়া দেওয়া হইয়াছেঃ মানুষকে সীমাবদ্ধ করা হইয়াছে; একের সহিত অপরের মিলনের স্বাধীনতার উপর মানুষের ভিত্তি রচিত হয় নাই, রচিত হইয়াছে মানুষের নিকট হইতে মানুষের বিচ্ছিন্ন হইবার স্বাধীনতার উপর।
এই অধিকার সেই বিচ্ছেদের অধিকার, সীমাবদ্ধ ব্যক্তিমানুষের অধিকার, আপনাতে আপনি আবদ্ধ হইয়া থাকিবার অধিকার… স্বার্থপরতার অধিকার… এই ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রত্যেক মানুষ অপরের মধ্যে তাহার নিজের স্বাধীনতার বিকাশ দেখে না, দেখে পরিসমাপ্তি। মানুষের এই ঘোষিত অধিকারগুলির কোনোটিই স্বার্থপর মানুষকে বুর্জোয়া মানুষকে ছাড়াইয়া যায় না। বুর্জোয়া যুগের এই স্বার্থপর মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ব্যক্তিগত কামনায় এমনভাবে অন্তর্মুখী হইয়া থাকে যাহাতে মনে হয় সে যেন সমগ্র সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন একটি স্বতন্ত্র জীব। (Zur Fadenfrage, ১৮৪৩)।
যে অহংকার নিজেকে চেনে, চেনে না নিজের দীনতাকে, সেই অহংকার বুর্জোয়া সমাজের বুদ্ধিজীবীদের মনে। ফ্রান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক সম্প্রতি তাহার বিশ্বাস ঘোষণা করিয়াছেন। যদিও ইনি আমার বন্ধু তথাপি তাহার ভাবধারার সহিত আমার বিচ্ছেদ আমি বেদনার সঙ্গে উপলব্ধি করি। তিনি লিখিতেছেনঃ
‘‘বিরাট ব্যক্তিপুরুষ কেবলমাত্র নিজের জন্যই জীবনধারণ করেন…নিষ্ঠার সহিত এই আদর্শে আসক্ত থাকিবার মত শক্তি ও মহত্ত্ব তাহার আছে। যে জনগণের উপর তিনি প্রভূত্ব বিস্তার করিতেছেন সেই জনগণের জন্য জীবনধারণ করিতেছেন বলিয়া ছলনা তিনি করেন না। … (ভ্যু স্যুর লে’রোপ, N.F.R. ১৫ই নভেম্বর, ১৯৩৪)। এই যে বড় বড় কথার আচ্ছাদনে তিনি নিজেকে সাজাইয়াছেন ইহার আড়ালে রহিয়াছে জীর্ণ চীর। তিনি নিজেকে স্বাধীন মনে করেন, নিজেকে মনে করেন ঈশ্বর ও প্রভু। কি লইয়া তাহার রাজত্ব! ধ্বংসস্তুপ।
‘‘বুর্জোয়া সমাজের দাসত্বকে বহির্দৃষ্টিতে মনে হয় সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা। কারণ, মনে হয় ইহা যাহা দিতেছে তাহা পরনির্ভরতা হইতে ব্যক্তিমানুষের পূর্ণ মুক্তি। কিন্তু এইখানে সম্পত্তি, শিল্প, (Industry), ধর্ম প্রভৃতি যাহা কিছুর সহিতই তাহার জীবনের যোগ নাই তাহারই অবাধ বিচরণের স্বাধীনতাকে সে নিজের স্বাধীনতা বলিয়া ভুল করে।’’ (মার্ক্সঃ Holy Family)।
লেখক হিসাবে আমাদের কর্তব্য (এবং এই কর্তব্য ক্কচিত কদাচিত আংশিকভাবে আমরা পালন করিয়াছি) এই অস্পষ্টতার অবসান ঘটানো, মার্ক্সের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া ‘অবাস্তব মানুষ’ হইতে মানুষকে সাহস ও শক্তির সহিত মুক্ত করিয়া আনা, মানবীয়তার (Humanism) সহিত সাম্যবাদের একাত্মতা বা স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মিলন ঘটান।
(ক্রমশ)