রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর…
সে সঙ্গে আনিল সেই সকল মহাপুরুষকে যাহারা স্বপ্ন হইতে শক্তি আহরণের মন্ত্র জানেন, উত্তাল উদ্দাম কর্মসাগরে ঝাঁপ দিতে যাহারা দ্বিধা করেন না; সঙ্গে আনিল নেতা গান্ধীকে, বীর বিবেকানন্দকে।
কিন্তু কর্মোন্মাদনার এই আগুন আমার পাহা্রে আগুনের মতই দীর্ঘদিন বৃথাই জ্বলিয়া আসিতেছিল। এ আগুন জ্বলিতেছিল তখন ‘‘বাঁচিবার জন্য বাঁচিয়া থাকার উদন্মাদনায়’’। আমার জাঁ ক্রিস্তফ আমার চোখ দিয়াই এই বাণীকেই পড়িয়াছিলেন আঁগাদিনের ঘরের সম্মুখে। বাঁচিবার জন্য বাঁচিয়া থাকা। যে স্নায়বিক অবসাদ ও নৈরাশ্যের যুগে আমার যৌবন কাটিয়াছে সে যুগে এ বড় সহজ কথা ছিল না।
কিন্তু ইহাই ত’ যথেষ্ট ছিল না। রঙ্গমঞ্চে যে গায়কেরা গাহিতে থাকে ‘চল আআমরা যাই’ অথচ কিছুতেই যায় না ইহাও যেন তাই, কারণ কোথায় যাইবে তাহা জনা ছিল না। এমনকি যে ক্রিস্তফ ‘‘কখনও দাঁড়াইয়া থাকে না’’ সেও তাহার ভ্রাতা রদাঁর সৃষ্টির মতই বহুদূর আগাইয়া গিয়াছে। অথচ তাহার মাথা নাই, শুধু একটি স্পন্দমান শক্তিমান হৃপিণ্ড লইয়া একটি অপূর্ণাঙ্গ মানুষ সে; তাহার যে দীর্ঘ চরণ দু’খানি তাহাকে নদীর ওপারে লইয়া গিয়াছিল, সে তাহার সহিত তাহার যুগকেও লইয়া গিয়াছিল। তাহার মত তাহার যুগও ছিল কবন্ধযুগ তথাপি সে আগাইয়া চলিয়াছিল ‘‘আগামী আলোকের’’ দিকে। কিন্তু কি সে আলোকে? দেখা গেল সে আলোক যুদ্ধ ও বিপ্লব।
ক্রিস্তফ এই পাগলামির আভাস পূর্ব হইতেই পাইয়াছিল, দুইবার সে ইহার নিকট আত্মসমর্পণ করিতে করিতেও করে নাই। কোনো মতে পালাইয়া গিয়া ‘‘যুদ্ধের ঊর্ধ্বে’’ কোথাও লুকাইয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিল। কিন্তু মৃত্যু আসিয়া যদি তাহাকে লইয়া না যাইত তবে তাহার মত মহান চরিত্রের মানুষ দীর্ঘদিন এই ঊর্ধ্বে থাকিতে পারিত না। এক পক্ষ অবলম্বন তাহাকে করিতেই হইত। এবং ‘‘মুগ্ধ হৃদয়’’ ষাট বৎসর বয়সে মৃত পুত্রের জন্য স্বেচ্ছায় সেই সংঘর্ষের মধ্যে ঝাঁপ দিলেন। এই সংঘর্ষের মধ্যে আমি নিজে ছিলাম। বেশিদিন ইহার বাহিরে আমি থাকিতে পারিতাম না। ‘‘ইউরোপে বিপ্লব প্রতিক্রিয়ার হাতে আক্রমণের উদ্যোগ রাখিয়া গিয়াছে, সম্মুখের ঘাঁটিগুলি শত্রু দখল করিয়াছে। ইউরোপের সর্বত্র ফ্যাশিজম্ নিজেকে নৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ত্রাণকর্তারূপে জাহির করিতেছে। সেই মহাশক্তিমান বুর্জোয়াশ্রেণী নিজের ক্ষমতার বিশ্বাস হারাইয়া ডুচেদের ও ফুয়েরারদের হাতে হত্যা ও ধ্বংসের গদা তুলিয়া দিয়াছে।
আর এই ডুচেরা ও ফুয়েরাররা জনসাধারণের মধ্য হইতে আসিয়াছে বলিয়া এখনও তাহাদের শক্তি অটুট আছে। ইহারা নেকড়ের জাত বলিয়া আজ পাহারাদার কুকুরে পরিণত হইয়াছে। কালোই হউক কটাই হউক, এই মহামারি দেশ হইতে দেশান্তরে ছড়াইয়া পড়িতেছে। যতই সাফল্য লাভ করিতেছে ইহার হিংস্রতাও ততই বাড়িতেছে। প্রশ্ন এড়াইয়া যাইবার দিন গিয়াছে। পক্ষে কি বিপক্ষে? হিংসা অহিংসা লইয়া শিক্ষালয়সুলভ আলোচনার কোনো মূল্যই আর আজ নাই। হিংসাই হউক অহিংসাই হউক, সকল শক্তিকে আজ প্রতিক্রিয়াশক্তির বিরুদ্ধে সংহত করিতে হইবে। সেনাবাহিনীর মধ্যে সকলেই স্থান করিয়া লইতে হইবে। এই দলে থাকিবে গান্ধীর সেই মহাশক্তিমান ‘‘না’’। থাকিবে লেনিনের দুর্জেয় সৈন্যদল। বিবেকের নির্দেশে যুদ্ধবিরোধিতা, কারখানায় ও যানবাহন‘‘ ব্যবস্থায় ধর্মঘট, সশস্ত্র উত্থান— এ-সব অস্ত্রই আজ আনেৎ-এর মন গ্রহণ করিয়াছে কারণ সংগ্রামের প্রয়োজন সে বুঝিয়াছে’’ (লা’নঁসিয়াত্রিস-এর শেষ পর্ব)।
(ক্রমশ)