শিল্পীর নবজন্ম

ফাইল চিত্র

রম্যাঁ রলাঁ

পূর্ব প্রকাশিতর পর

কিন্তু তাহারা অতি সাবধানীর সতর্ক পন্থা অবলম্বন করিলেন, অর্থাৎ একেবারে নীরব হইয়া গেলেন। বুদ্ধিমানের মত চুপ করিয়া যাওয়া বেশ লাভের ব্যবসা লাভের ব্যবসা, অতএব শীঘ্রই তাহারা দল ছাড়িয়া দিলেন। যে সামান্য কয়জন বিরোধীদলে যোগ দিল না, অর্থাৎ চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একনিষ্ঠ সৈনিকের মত যাহারা প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হইতে বিরত হইল না, তাহাদেরও মানসিক জীবনে এমন একটি গভীর বিশৃঙ্খলা দেখা দিল যাহার ফলে তাহাদের সমস্ত কর্মোদ্যম ব্যর্র্থ হইয়া গেল। কম্পাশের কাঁটা উত্তরমুখহীন হইবার প্রয়াসে একমুহূর্তে বাম হইতে একেবারে দক্ষিণে চলিয়া গেল। ক্লার্তে দলের মধ্যে যে দ্বিধা ও অসঙ্গতি দেখা দিল, তাহা না দেখিলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। এই দলটি অবশ্য তাহার পর হইতে আজ পর্যন্ত আক্লান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সহিত বিপ্লবী বাহিনীর পুরোভাগে সংগ্রাম করিয়া আসিতেছে। কিন্তু ১৯১৯ সালের সেই পথ খোঁজাখুঁজির প্রথম কয়েক মাস ক্লাতে দলও সংশয়দোলায় দুলিয়াছিল, এবং দ্বিধাদ্বন্দ্বের নাগপাশ হইতে সবলে আপনার ছিন্ন করিয়া স্থির ও সুস্থ থাকিতে পারে নাই, একেবারে অসহিষ্ণু চরমপন্থী হইয়া উঠিয়াছিল। বারবুস্ ও মার্সেল মাতিনে প্রমুখ তাহাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠ কর্মীগণ চিন্তার স্বাধীনতাকে তুচ্ছ করিয়া বিপ্লবের পায়ে এই স্বাধীনতার বিনাসর্তে আত্মসমর্পণের দাবী জানাইয়াছিলেন। এই আত্মসমর্পণ ইতিপূর্বে তাহারা নিজেরাই করিয়াছিলেন।


বিপ্লব ও চিন্তার স্বাধীনতা ইহাদের কোনোটিকেই আমি পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত ছিলাম না, এই দুইটিকেই একসঙ্গে রক্ষা করিতে করিতে আমার সর্বশক্তি ব্যয় হইয়াছে। তখনকার দিনে কোনো দলে না থাকাটা ছিল সবচেয়ে নিরানন্দ কাজ, যে কাজে কোনো পুরষ্কার ছিল না, কাহবা ছিল না, স্বীকৃতি পর্যন্ত ছিল না। বিপ্লবীদের অন্ধ আপোশহীন মনোবৃত্তির সহিত চিন্তার স্বাধীনতার তখন সংঘর্ষ শুরু হইয়া গেল। সোভিয়েট রাশিয়ার বিপ্লব যখন আত্মরক্ষার জীবনমরণ সংগ্রামে রত সেই চরম সঙ্কটসঙ্কুল কয়েক বৎসর বিপ্লবীদের এই অন্ধ অনমনীয় মনোভাব বিশেষভাবে প্রকট হইয়া ওঠে। বিপ্লবের এই অতিরিক্ত দাবীর ফলে স্বাধীনতার আদর্শবাদীদিগের বিরোধিতা না করিয়া বরং এতখানি বাড়িয়া গেল যে, তাহারা সংগ্রাম হইতেই একেবারে দূরে সরিয়া যাওয়ার কথা পর্যন্ত বিবেচনা করিতে লাগিলেন।

পৃথিবী ব্যাপিয়া তখন হিংসার তাণ্ডব চলিয়াছে; ইহার নিকট যাহারা তাহাদের সত্তাকে বলি দিতে অস্বীকার করিলেন—জাতিগত বা শ্রেণীগত সর্বপ্রকার দেশপ্রেমের এবং জাতীয় অথবা সামাজিক সর্বপ্রকার একনায়কত্বকে যাহারা বিনা দ্বিধায় বর্জন করিলেন তাহাদের নিকট আমার ক্লেরাঁবোল (Clerambault) মহাপুরুষ ও শহিদ হইয়া গেল। ‘‘সবার বিরুদ্ধে একাকী’’ (ইহাই বইখানির প্রথম নামকরণ করিয়াছিলাম)— অর্থাৎ স্বাধীন বিবেক, স্বাধীনতার পায়ে যাহা আত্মোৎসর্গ করিয়াছে। বারবুসের পত্রিকা মদ (Monde)-এ তিনটি প্রবন্ধ লিখিয়া (১৯২০ ডি়সেম্বর ও ১৯২১ জানুয়ারী) তৎক্ষণাৎ বের নিয়ে উহাকে শেষ করিয়া দিলেন। বিবেকের নির্দেশে যুদ্ধবিরোধী (conscientious objectors) সকল ফরাসীই এই বইখানিকে কেন্দ্র করিয়া সম্মিলিত হইতে লাগিলেন, কিন্তু নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য সম্বন্ধে তখনও ইহাদের সংশয় ও দ্বিধা ছিল।
ইহার অল্পকালের মধ্যেই আমার চিন্তাগগনের দিগন্তে গান্ধীর সুদূর তারকা দেখা দিল। এই তারকার আলোককেই আমি পরে সমস্ত ইউরোপে প্রতিফলিত করি।

(৩)
১৯২০ সালে ডিসেম্বরে তুর (Tours) কংগ্রেসে ফরাসী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া গেল।

দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠের বিরুদ্ধে ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হইল। লগে (Longuet) ছিলেন আমার বন্ধু। ব্লুম্ (Blum) ও রেণোদেলের (Renaudel) সহিত যোগদান না করিতে অনুরোধ করিয়া তাহাকে আমি পত্র লিখিলাম। এমন কি তাহাকে আমি জনজীবন হইতে অবসর গ্রহণ করিতে পর্যন্ত অনুরোধ করিলাম। সকলেই জানেন সে অনুরোধ তিনি রাখেন নাই। তিনি আমাকে পপুলেয়র (Populaire) পত্রিকায় টানিবার চেষ্টা করিলেন। তখন ল্যুমানিতে পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ বন্ধ হইয়া গিয়াছে তথাপি আমি তাহার অনুরোধ রক্ষা করিতে অস্বীকার করিলাম (১৯শে মার্চ ১৯২১) জানাইলাম তাহার পত্রিকা যে পন্থা গ্রহণ করিয়াছে তাহাতে আমার সম্মতি নাই। ‘‘যে পাপ বিরোধের ফলে সমাজতন্ত্র দুইটি অংশ বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হইয়া পড়ে’’ তাহার মধ্যে আমি থাকিতে চাহিলাম না।

সে কয় বৎসর আমার প্রধান কাজ হইল ফ্রাঁন্সের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সমস্ত বিপ্লবী বামপন্থী শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং ফ্রান্সের বাহিরে সমস্ত জাতির স্বাধীন চিন্তাবীরদের লইয়া একটি আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ গঠন করা।

আমার এই দ্বিমুখী অভিযান ব্যর্থ হইয়া গেল রাজনৈতিক দলগুলির পরম অসিহিষ্ণুতার জন্য। হিংসার নিকট মনের এই আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে আমি সে সময় (১৯২১-১৯২২) অবিশ্রাম অভিযান চালাইয়াছিলাম। তখনকার দিনের সে উন্মত্ততার মধ্যে এই হিংসাকে শুধুমাত্র অস্ত্র বলিয়া বিবেচনা করা হইত না, উহাকে পতাকার সম্মান দেওয়া হইত। বোলশেভিকদের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে অদলীয় বিপ্লবীদের আকুল আবেদন, রাশিয়া হইতে প্রত্যাগত আমার বিশ্বাসভাজন বন্ধুদের নিকট শোনা অত্যাচারের কাহিনী এবং সর্বোপরি গোর্কির চিঠিগুলি আমার বিদ্রোহকে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিল। গোর্কি তখন সদ্য সোভিয়েট ইউনিয়ন ছাড়িয়া আসিয়াছেন এবং তিক্ত বিষণ্ণ নৈরাশ্যে তাহার মন ভরিয়া উঠিয়াছে। মনের স্বাধীনতা আরও বেশি করিয়া আমার রণপতাকা হইয়া উঠিল। তথাপি, ইহা যাহাতে আমার সংগ্রাম হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার আজুহাত হইয়া উঠিতে না পারে, সে বিষয়ে আমি সতর্ক থাকিলাম। শুধু সতর্ক থাকিয়াই ক্ষান্ত থাকিলাম না, সর্বহারার সংগ্রামের আকাশেই সে পতাকাকে আমি উড্ডীন দেখিতে চাহিলাম।

(ক্রমশ)