উদ্বেগ বাড়ছে

ফাইল চিত্র

ধর্মীয় মেরুকরণের তাস খেলছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কখনও কংগ্রেসের ইস্তাহারকে বলছেন, ‘মুসলিম লিগের ঘোষণাপত্র’, কখনও আবার ওরা ক্ষমতায় এলে মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেবে’ বলে মন্তব্য করেছেন। ‘আচ্ছে দিন’, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ ভুলে আমজনতাকে ধর্মের টনিক গেলানার ফল মিলেছে হাতেনাতে। গত এক বছরে দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। ২০২৪ সালেই এমন ঘটনা ঘটেছে ৫৯টি। আর এর মধ্যে ৪৯টি ঘটেছে বিজেপি শাসিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্যে। সেন্টার ফর স্টাডি অব সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে এই তথ্য।

এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সংখ্যা ছিল ৩২। ২০২৪ সালে তা এক লাফে বেড়ে ৫৯-এ পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এক বছরে ৮৪ শতাংশ বেড়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিশানা করা হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। মারা গিয়েছেন ১৩ জন। এঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১০ জন এবং ৩ জন হিন্দু। বছরভর চলা এমন ধর্মীয় হিংসার আঁতুড়ঘর মহারাষ্ট্র। বিজেপির নেতৃত্বে মহাযুতি জোট সেখানে এখন ক্ষমতায়। গত বছর সে রাজ্যে মোট ১২টি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। তালিকায় এরপরই রয়েছে যৌথভাবে বিহার ও উত্তরপ্রদেশ।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যতই বলুন না কেন ‘সব ঠিক হ্যায়’, আসলে অহিংস গৌতম বুদ্ধের বিহারের চিত্রটা মোটেই ঠিক নেই। ‘দলবদলু’ নীতীশের জমানায়ও বিহারে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের খামতি নেই। লোকসভা নির্বাচনে রামের নামে উত্তরপ্রদেশে কোনওরকমে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছে বিজেপি। রামমন্দির ইস্যুকে সামনে রেখে আখের গুছিয়েছেন যোগী ও মোদী। আর সেই রামরাজ্যেই বর্তমান সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চরমে।


পিছিয়ে নেই মোদীর সাধের রাজ্য গুজরাতও। যে রাজ্যকে মডেল বানিয়ে দেশকে বিশ্বগুরুতে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, সেখানেই চরম অরাজকতা। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা ও রাজস্থানেও পরিস্থিতি প্রায় একই।

আরও এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে। বছরের ৫৯টি সংঘর্ষের ঘটনার মধ্যে ২৬টি ঘটেছে কোনও না কোনও ধর্মীয় উৎসব বা ধর্মীয় মিছিলকে কেন্দ্র করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অযোধ্যায় রামমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পৃথক পৃথক চারটি হিংসার ঘটনা ঘটে। একইভাবে ফেব্রুয়ারি মাসের সরস্বতী প্রতিমার নিরঞ্জনকে ঘিরে সাতটি, গণেশ পুজোর চারটি ও বকদি-ইদে দু’টি হিংসার ঘটনা সামনে এসেছে। বর্তমানে উপাসনাস্থল নিয়েও দানা বাঁধছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। মন্দিরের অস্তিত্ব, মসজিদের সমীক্ষা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিতর্কের জেরে প্রায় ছ’টি হিংসার ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলেও নেমেছিলেন স্বয়ং সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। তাঁকে বলতে শোনা যায়, রামমন্দিরের মতো ইস্যু আর চাই না দেশে। শুধু ঘৃণা আর শত্রুতার বশবর্তী হয়ে অন্য কোনও জায়গা নিয়ে এই ধরনের ইস্যু তৈরির চেষ্টা করলে সেটাকে কিছুতেই সমর্থন করা যাবে না। আর এসএস প্রধানের এই মন্তব্যের পরও মন্দির-মসজিদ বিতর্ক থামেনি।

বস্তুত নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, বিভেদ-বৈষম্য, ঘৃণাভাষণ থামার কোনও লক্ষণ নেই। দেশে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের এই ন্যক্কারজনক ছবি ধরা পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থার রিপোর্টে। ‘ইন্ডিয়া হেডল্যাপ’ নামে ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, প্রতি নথিভুক্ত ঘৃণাভাষণের সংখ্যা ছিল ৬৬৮টি। সবচেয়ে বেশি এই তিনটি রাজ্য থেকেই ঘৃণাভাষণের ৪৩ শতাংশ অভিযোগ উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে ৭৫ শতাংশ অভিযোগও উঠেছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি থেকে। এই বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করে মার্কিন সংস্থাটি জানিয়েছে, ইজরায়েলের সঙ্গে হামাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জেরেই এদেশে ঘৃণাভাষণ বেড়ে গিয়েছে। প্রায় একই ছবি এখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। পড়শি দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এই অজুহাতে দেশের সংখ্যালঘুদের টার্গেট করছে হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ। দেশের গেরুয়া শাসকবাহিনী অবশ্য এইসব রিপোর্টে আমল দিতে নারাজ। সাম্প্রদায়িক বিভাজনই আরএসএস-বিজেপির মূলমন্ত্র। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ওরা মুছে দিতে চায়।

সেন্টার ফর স্টাডি অব সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজমের সাম্প্রতিক রিপোর্ট সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের যে ছবি সামনে নিয়ে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়।