কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার পরিকল্পনামাফিক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গেরুয়াকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ করছে বলে অভিযোগ উঠছে বিরোধী শিবির থেকে। অভিযোগের সমর্থনে ইতিহাসের সিলেবাসে মুঘল সহ ইসলামি জমানার শাসকদের ভিলেন, অত্যাচারী বলে দেখিয়ে সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেছে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলি। এই প্রেক্ষাপটে দুর্গাপুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এনআইটি) পুরীর শঙ্করাচার্য নিশ্চলানন্দ সরস্বতীজি মহারাজকে নিয়ে এসে বৈদিক জ্ঞান প্রচার ও দীক্ষা দানের কর্মসূচি নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। কেন প্রযুক্তি বিজ্ঞান গবেষণার নামজাদা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম-আধ্যাত্মিকতার প্রচার হবে, প্রশ্ন তুলে সরব বিভিন্ন মহল। বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ বনাম ধর্ম-আধ্যাত্মিকতা না উভয়ের সহাবস্থান—শঙ্করাচার্যের কর্মসূচির উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক উঠেছে তুঙ্গে, যার কেন্দ্রে রয়েছে এই নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যদিও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে ধর্ম, ঈশ্বর বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিকতার কোনও সংঘাত-বিরোধ নেই। যেমন, চিকিৎসকরা মুমূর্ষূ রোগীকে বাঁচাতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রচেষ্টার খামতি না রাখলেও শেষ পর্যন্ত ভগবানের ওপর ভরসা রাখার কথা বলেন। তাই এমন সংঘাত, বিরোধের কোনও অবকাশ নেই।
এনআইটি-র তরফে অবশ্য বলা হয়, শঙ্করাচার্য প্রথম দিনে যুবশক্তির মধ্যে বৈদিক জ্ঞান প্রচার করবেন। পরদিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের বেদান্ত দর্শন ও দীক্ষা সংক্রান্ত ভাষণ দেবেন। কেউ দীক্ষা নিতে চাইলে দীক্ষাও দেবেন। সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে, প্রযুক্তি শিক্ষার অঙ্গণে কেন বেদান্ত চর্চা ও দীক্ষাদানের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রশ্নের মুখে পড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর অরবিন্দ চৌবে অবশ্য বলেছেন, ‘যুবশক্তির মধ্যে জ্ঞান প্রদান করবেন শঙ্করাচার্য। তাঁর এই কর্মসূচি আমাদের এখান থেকে ঠিক হয়নি। ঠিক হয়েছে দিল্লি থেকে। উনি আসবেন। জ্ঞান প্রচার করবেন। তাঁর কাছে কেউ যদি কিছু জানতে চান, তিনি জানাবেন। কেউ চাইলে দীক্ষাও দিতে পারেন। অনেক যুবক মানসিক অবসাদে ভোগেন। তাঁদের অবসাদ কাটানোর জন্য নানা পরামর্শ দেবেন। যুবশক্তি কোনও ধর্মের হয় না, এমন মন্তব্যও করেন এনআইটি-র ডিরেক্টর অরবিন্দ চৌবে।
প্রত্যাশিতভাবেই পুরীর শঙ্করাচার্যের আসন্ন অনুষ্ঠান ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্মীয় মেরুকরণ হচ্ছে। সবটাই হচ্ছে আরএসএস-এর মদতে। অন্যায় হচ্ছে। আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-ও তাদের সোশাল মিডিয়ার পেজে সরাসরি ধর্মীয় বার্তা দেয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।’ সিপিআইএমের তরফেও এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সেখানে কোনও সরকারি জায়গায় ধর্মীয় কিছু হতে পারে না। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সেই নিরপেক্ষতা ভেঙে দিতে চাইছে। বামপন্থীরা এর প্রতিবাদ করছে এবং আগামী দিনেও অন্ধ হিন্দুত্ববাদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবে।’ বিজেপির আঞ্চলিক নেতৃত্ব অবশ্য বলছে, ‘এনআইটি প্রতিষ্ঠান কোনও ধর্মগুরুকে নিয়ে আসবে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। কেউ কেউ অবশ্য বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে তোল্লা দিয়ে থাকে। তাই তারাই কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মগুরুর আসা নিয়ে নানা মন্তব্য করছে।’
ইতিপূর্বে পাঠ্যপুস্তকে আরএসএসের চাপে সিলেবাসে সরাসরি হিন্দুত্বের প্রচার, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের আসনে সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ শিক্ষাবিদদের বসানো, এরপর শিক্ষাঙ্গণে সরাসরি ধর্মগুরুদের নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে মোদী-শাহ বাহিনী কায়েম করতে চাইছে একচ্ছত্র আধিপত্য। সর্ব:জনীন অধিকার হিসাবে শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত না করে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রসারের মাধ্যমে মানুষের বিবেক ও চরিত্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পিত চেষ্টা চলছে। এর বিরুদ্ধে বিবেকবান শিক্ষাবিদরা প্রতিবাদ জানালেই ‘শহুরে নকশাল’ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে তকমা। যে কোনও বিষয়ে কমিশন, তদন্ত রিপোর্ট (এমনকি তা কেন্দ্রের হলেও) গুরুত্ব না দেওয়াটাই এই সরকারের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।