সুদীপ্ত দে
ভোটার তালিকার সংশোধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রত্যেক বছরই এতে নতুন কিছু নাম ঢোকে, মৃতদের নাম বাদ যায়। অথচ, এ বার বিজেপি এবং নির্বাচন কমিশন মিলে এমন এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে, যাতে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি– ব্যাপক দুর্নীতি, ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি, সীমাহীন বেকারত্ব, মহিলাদের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা আক্রমণ, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্য, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া ইত্যাদি জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সব পিছনে পড়ে গিয়েছে। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেই প্রশ্ন উঠছে, এই সব নথিপত্র আমাদের নেই, তা হলে কি ভোটার তালিকায় নাম থাকবে না? আচ্ছা, আমাদের ছেলেমেয়েরা তো ২০০২-এর পর জন্মেছে, তা হলে কী করে তাদের নাম তুলব? এ রকম বহু অনিশ্চয়তার ফলে অসংখ্য মানুষ আতঙ্কিত। নাগরিকত্বহীন হওয়ার আতঙ্ক মানুষকে তাড়া করছে। অথচ এমন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির তো দরকার ছিল না। তা হলে, তা করা হলো কেন?
আসলে এসআইআরের মধ্য দিয়ে আদৌ কোনও অনুপ্রবেশকারী খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক, শাসক বিজেপির কাছে এই আতঙ্কটি সৃষ্টি করারই দরকার ছিল। এর আগেও ভোটার তালিকায় ইন্টেনসিভ রিভিশন হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন তিনরকম ভাবে ভোটার তালিকা সংশোধিত হয়ে এসেছে। নিবিড় সংশোধন (ইন্টেনসিভ রিভিশন), সংক্ষিপ্ত সংশোধন (সামারি রিভিশন), চলমান সংশোধন (কন্টিনিউয়াস রিভিশন)। আগে বহুবার নিবিড় সংশোধন হলেও স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন এবারই প্রথম। সর্বশেষ নিবিড় সংশোধন হয়েছিল ২০০২ সালে। তখন এটা নিয়ে বিশেষ হইচই হয়নি। কিন্তু এবার হচ্ছে। হইচই শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা দেশেই হচ্ছে। কারণ, সাধারণত যেভাবে ভোটার তালিকা সংশোধন এত দিন হয়ে এসেছে, এবার নির্বাচন কমিশন সেভাবে করার কথা বলছে না। অতি সম্প্রতি নয়া পদ্ধতিতে বিহারে, এসআইআর হয়ে গেছে। এবার পশ্চিমবঙ্গ সহ আরও ১২টি রাজ্যে শুরু হলো। আগের সঙ্গে এবারের পার্থক্য কী আগের পদ্ধতিতে ইন্টেনসিভ রিভিশন শুরু হয় সর্বশেষ ভোটার তালিকা নিয়ে।
২০০২-এও ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে শেষ প্রকাশিত ভোটার তালিকা নিয়ে। বিএলও-রা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা মেনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিছু প্রশ্ন করতেন। যাঁদের নাম আছে, দেখা হয় তাঁরা বেঁচে আছেন কি না এবং সত্যি সত্যিই উল্লিখিত ঠিকানায় আছেন কি না। থাকলে নতুন ভোটার তালিকাতে তাঁদের নাম এমনিতেই উঠে যেত। কোনও রকম ফর্ম ফিলাপ করা বা ডকুমেন্ট দিতে হয় না। এই পদ্ধতিটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ছিল। কারণ যাঁর নাম একবার ভোটার তালিকায় উঠেছে, যথাযথ প্রমাণপত্র যাচাই করার পরই তা উঠেছে। ভোটার তালিকায় উল্লিখিত ঠিকানা পাল্টালে অথবা কারও দুই জায়গায় নাম থাকলে এক জায়গায় নাম বাদ যেত। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সালে ৮ মাস ধরে নিবিড় সংশোধন হয়েছিল। তাতে ২৮ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছিল। কোনও হইচই হয়নি।
রিপোর্ট অনুযায়ী, সর্বাধিক ৩১৩ জন। এর মধ্যে ৭৮ জন মুসলমান, বাকি ২৩৫ জন নেপালি হিন্দু। এই ৩১৩ জন অনুপ্রবেশকারী খুঁজে বার করার জন্য ৭ কোটি ৭৩ লাখ মানুষের প্রত্যেককে ডকুমেন্ট দিয়ে প্রমাণ করতে হয় তাঁরা অনুপ্রবেশকারী নন। অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারী খোঁজার যে দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র দপ্তর পালন করেনি, তার দায় সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁদেরই প্রমাণ করতে বলা হয় যে তাঁরা ভারতীয় নাগরিক। ভোটার তালিকা সংশোধন করাই যদি নির্বাচন কমিশনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হতো তাহলে এতদিন যেভাবে হয়েছে, সেইভাবেই তা করতে পারত। তা না করে বিধানসভা নির্বাচনের এত কাছে এত কম সময়ের মধ্যে তা করতে গিয়ে মানুষকে এ ভাবে আতঙ্কিত করা কেন?
পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত চিফ ইলেক্টোরাল অফিসারের গত ১১ সেপ্টেম্বরের একটি চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে যে, দুটি তালিকা, ২০০২ সালের ১ জানুয়ারির ভোটার তালিকা ও ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারির ভোটার তালিকা নিয়ে এসআইআর শুরু হবে। বিহারে যে নিয়মে এসআইআর হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেই নিয়মে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন, এনুমারেশন ফর্মে পরিবারের যে কেউ সই করতে পারবে, এনুমারেশন ফর্মের সঙ্গে তখনই কোনও ডকুমেন্ট দিতে হবে না। যাদের ডকুমেন্ট দিতে হবে তাদের তালিকা নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবে। বাবা-মা-এর নাম ২০০২-এর ভোটার লিস্টে না থাকলেও অন্য কোনও আত্মীয়ের নাম উল্লেখ করা যাবে। এই রকম কিছু নিয়মের পরিবর্তন করা হয়েছে। এটা যে হয়েছে তা বিহারে এবং এ রাজ্যে প্রবল গণবিক্ষোভের চাপেই। এর ফলে সাধারণ মানুষের কিছু সুবিধা হলেও কমিশনের ভূমিকায় স্পষ্ট হচ্ছে নাম বাতিলই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এখন নির্বাচন কমিশন বলছে যে ১৯৮৭ সাল বা তার পরে যারা জন্মেছেন, তাঁরা ভোটার কি না তা সন্দেহজনক। তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁদের বাবা বা মা ২০০২ সালে ভোটার ছিলেন। এটা কার্যত ২০০৩ সালের আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব প্রমাণের চেষ্টা। এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেনস) হচ্ছে ঘুরিয়ে। বিজেপি সরকার আসামে এনআরসি করে সেখানে নাগরিকত্ব খোঁজার চেষ্টা করেছিল, সেখানেও আনুষ্ঠানিক ভাবে এনআরসি শুরু করার আগে ভোটার তালিকা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। বিজেপির ইচ্ছা ছিল সারা দেশে এনআরসি করার, করতে পারেনি। এখন নির্বাচন কমিশনকে সঙ্গী করে সেই কাজে নেমেছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পদদলিত করে অত্যন্ত অগণতান্ত্রিকভাবে সিএএ এনেছে। মতুয়া কার্ড খেলেছে। এখন বহু জায়গায় ক্যাম্প খুলে সিএএ-এর ফর্ম পূরণ করাচ্ছে। বলছে, এতেই নাকি নাগরিকত্ব অর্জন করা যাবে। নাগরিকত্ব নির্ধারণ করবে নির্বাচন কমিশন! কমিশন বলছে, আধার কার্ড, রেশন কার্ড এমনকি তাদেরই দেওয়া ভোটার আইডি কার্ড ভোটদাতার প্রামাণ্য নথি হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু কমিশন বিশেষ নিবিড় সংশোধনের নামে বিশেষ মতলবে অন্য কোনও কাজ করেছে। সম্প্রতি কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনে কমিশনের বিরুদ্ধে কারচুপি করে লক্ষ লক্ষ ভুয়ো ভোটারের নাম ঢোকানো, ডুপ্লিকেট ভোট, ভুয়ো ঠিকানা, বিরোধী দলগুলিকে ডিজিটাল ভোটার তালিকা না দেওয়া, সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে অস্বীকার করা ও অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে সব অভিযোগের কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি।
নির্বাচন কমিশন যে সব নথি নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে চাইছে, তা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠেছে। দেশের কত শতাংশ মানুষ চাকরি করেন? যাঁদের চাকরি নেই বা কখনও ছিল না তাঁরা কী ভাবে চাকরির পরিচয়পত্র বা পেনশনের কাগজ দেখাবেন? ১৯৮৭ সালের আগে কত জন মানুষের ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস অ্যাকাউন্ট, এলআইসি পলিসি ছিল? ওই সময় কত জনের জন্ম সার্টিফিকেট ছিল? শিক্ষার সুযোগ যাঁরা পাননি, তাঁরা কী ভাবে শিক্ষাগত সার্টিফিকেট দেখাবেন? বিহারে এনআরসি হয়নি। অথচ এনআরসিতে নাম থাকার নথি কমিশন নির্ধারিত ১১টির একটি। পশ্চিমবঙ্গে ছিটমহলের বাসিন্দাদের কাছে কমিশন নির্ধারিত একটিও কাগজ থাকা সম্ভব নয়। তাদের কথা কথা কমিশন কি ভুলেই গেছে! অর্থাৎ অধিকাংশ গরিব মানুষের যে সব কাগজ কোনও দিন ছিল না বা যা তাঁদের নেই, কমিশন সেই সব কাগজপত্রকেই নথি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে, যেগুলি না থাকলেই তিনি ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন।
পুরনো নথিপত্র যাদের হারিয়ে অথবা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তাঁরা দিনের পর দিন সরকারি দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করে, হয়রান হয়ে, দালাল চক্রের পাল্লায় পড়েও সে সব কাগজ উদ্ধার করতে পারবেন তার কোনও গ্যারান্টি আছে? বছর বছর বন্যার কবলে পড়া মানুষ কিংবা যাঁদের পরিযায়ী হয়ে রোজগার করতে হয় তাঁরা ২০-২৫ বছর আগের তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দার নথি যত্ন করে কোথায় রাখবেন? হঠাৎ ফরমান দিয়ে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ডের গ্রহণযোগ্যতা রাতারাতি বাতিল করা হল। বিহারে প্রথম পর্যায়ের ৬৫ লক্ষ এবং খসড়া তালিকা থেকে ৩.৩৬ লক্ষ অর্থাৎ প্রায় ৬৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গেল। তার ৭৫-৮০ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র। কেউ খেতমজুর বা ভূমিহীন চাষি, কেউ পরিযায়ী শ্রমিক, কেউ গৃহপরিচারিকা। দেশের মানুষের করের লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে আধার কার্ড তৈরি করার পর সরকার আধারকে এতই প্রামাণ্য এবং নির্ভরযোগ্য হিসাবে তুলে ধরল যে, ব্যাঙ্ক, রেশন, গ্যাস সহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে আধার সংযোগ বাধ্যতামূলক করা হল। অথচ এখন বলা হচ্ছে, আধার কার্ড ভোটদাতা হিসাবে নাগরিকের নির্ভরযোগ্য পরিচয়পত্র নয়। কারণ কী? কারণ নাকি আধার কার্ড জাল হচ্ছে।
সরকার তার অপদার্থতার দায় জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে না। আসলে জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরির, সংখ্যালঘু মানুষকে বিদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়ার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের যে কার্যক্রম, সেটাই তারা এসআইআরের মধ্য দিয়ে করতে চাইছে। মানুষকে এসআইআরের নামে অস্তিত্বের সংকটে ফেলতে চাইছে। জনজীবনের যে জ্বলন্ত সমস্যাগুলো– দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, মহিলাদের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা আক্রমণ, শিক্ষা-চিকিৎসার সমস্যা, যেগুলি সমাধান করতে কেন্দ্র এবং রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা পুঁজিবাদী সরকারগুলি পুরোপুরি ব্যর্থ, এসআইআরের মধ্য দিয়ে সরকার এই সমস্ত সমস্যাগুলিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে, সামনে নিয়ে এসেছে নাগরিকত্বের সমস্যাকে। অর্থাৎ তুমি আগে দেখ ভোটার তালিকায় তোমার নাম আছে কি না, তুমি আদৌ ভারতের নাগরিক কি না, তারপর তো দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, নারী নির্যাতন নিয়ে মাথা ঘামাবে। তা ছাড়া তোমার এত সব নিয়ে ভাবার দরকারটা কী? সুপ্রিম কোর্ট যখন বলল, অন্য প্রামাণ্য নথিগুলোর সঙ্গে আধার কার্ডকেও প্রামাণ্য নথি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, কমিশন তা করল না।
এখনও বলছে, আধার জমা দিলেও সন্দেহ হলে কমিশন অন্য নথি দেখতে চাইবে। এর থেকেই স্পষ্ট এসআইআর-এর উদ্দেশ্য সঠিক ভোটার লিস্ট তৈরি করা কিংবা সঠিক নাগরিক নির্ধারণ করা নয়। এর থেকেই স্পষ্ট, জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি থেকে ক্ষুব্ধ জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কৃত্রিম এবং জটিল সমস্যার মধ্যে ফেলে তাকে ঘুরপাক খাওয়ানোই এর লক্ষ্য। এর পিছনে মূল উদ্দেশ্য হল, এক অংশের মানুষের ত্রাতা সেজে অন্য অংশের মানুষকে সন্ত্রস্ত রেখে তাদের দিয়ে ভোটবা’ ভরানো। বিজেপি এবং শাসক দলগুলির এই হীন উদ্দেশ্যের মুখোশ খুলে দেওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি।