শান্তনু রায়
কিঞ্চিৎ অভিমানে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমার নিজস্ব জীবন আমি কোনোকালে যাপন করিনি।’ তিনি ১৮৮৮র ২৭ নভেম্বর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ভুমিষ্ঠ রথীন্দ্রনাথ৷ রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনীর জ্যেষ্ঠপুত্র, যিনি নিজে অনেক গুণের অধিকারী হয়েও প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিশ্বখ্যাত পিতার অনুশাসন ও ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে গিয়ে নিজের ইচ্ছা ও স্বপ্নকে স্বেচ্ছায় অন্তর্জলি ঘটিয়েছেন বা ঘটতে দিয়েছেন একাধিকবার। তিনিই নিজের সম্পর্কে পরিণত বয়সে লিখতে পারেন— ‘বাড়ির মধ্যে আমারই রঙ কালো, চেহারায় বুদ্ধির পরিচয় ছিল না, স্বভাব অত্যন্ত কুনো, শরীর দুর্বল। মনস্তত্ত্বে যাকে বলে হীনমন্যতা, তা যেন ছেলেবেলা থেকেই আমার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। বড়ো হয়েও সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছি বলতে পারি না।’ তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য আশ্রমের একেবারে প্রথম দিকের ছাত্র। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ ও ব্রহ্মবান্ধবের যৌথ উদ্যোগে আরম্ভ হওয়া শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের প্রথম দশজন ছাত্রের মধ্যে আটজনই ব্রহ্মবান্ধবের; বাকী দু’জন রবীন্দ্রনাথের দুই পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ।
শান্তিনিকেতনে স্কুল জীবনের শিক্ষাশেষে ১৯০৬-এ তাঁকে ও তাঁর সহপাঠী সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে জাপানে পাঠানো হয় কৃষিবিদ্যা শিক্ষা গ্রহণের জন্য। সেখান থেকে তাঁরা শিক্ষালাভের জন্য গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার ইলিয়নয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০৯-এ কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু তারপরই আর ওদেশে না থেকে রবীন্দ্রনাথের ডাকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে ১৯০৯-এ ফিরে এলেন শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে। সেখানে তিনি একটি কৃষি খামারের পত্তন করেন৷ উন্নত ধরনের লাঙল ও যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করার ব্যবস্থা করেন। মৃৎবিজ্ঞান বিষয়ে বিদেশে তাঁর অধীত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য একটি ল্যাবরেটরিও স্থাপন করেন। পতিসর ও কালীগ্রাম অঞ্চলে নিজে ট্র্যাক্টর চালিয়ে প্রজাদের জমি চাষ করতে শিখিয়েছিলেন। কৃষকদের মধ্যে আলু, টম্যাটো এবং আখের চাষের সূচনা করেন। এভাবেই তিনি পিতার গ্রামোন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘১৯১০ সালের সেই সময়টাতে আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনও ঘটেনি।’ পিতার ইচ্ছাপুরণে রথীন্দ্রনাথ আত্মত্যাগ করে গেছেন আজীবন, নিজস্ব ইচ্ছা মতামতব্যক্ত করতে প্রয়াসী হননি, দ্বিরুক্তি করেননি পিতৃআজ্ঞা পালনে।
পিতার ইচ্ছানুসারেই ১৯১০-এর ২৭ জানুয়ারি বিয়ে হল রথীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নি পাঁচ বছরের ছোট বিধবা প্রতিমাদেবীর সঙ্গে। ঠাকুরবাড়িতে সেই প্রথম বিধবা বিবাহ। যদিও মৃণালিনীদেবী তখন প্রয়াত, তবে তাঁরও নাকি শৈশবের প্রতিমাকে দেখেই তাঁকে পুত্রবধু করার বাসনা হয়েছিল।
কিন্তু সুন্দরী শিক্ষিতা প্রতিমাদেবীর তখন বিয়ে হয়ে যায় গুণেন্দ্র নাথের ছোট বোন কুমুদিনীর নাতি নীলানাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই নীলানাথ গঙ্গায় ডুবে অকালে প্রয়াত হন। এরপর রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত স্ত্রীর মনোবাঞ্ছাপুরণে বিধবা কিশোরী প্রতিমার সঙ্গেই নিজে দাঁড়িয়ে রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দেন, তৎকালীন সামাজিক কুসংস্কারের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে।
যদিও ভগ্নিপতি নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা রথীন্দ্রনাথের পত্র থেকে জানা যায়, বিধবা প্রতিমাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল প্রধানত পিতৃদেবের ইচ্ছাপুরণে৷ তবে বিবাহোত্তর জীবনের বেশ কিছুকাল অন্তত যে সুখেই কেটেছিল তার উল্লেখ আছে নগেন্দ্রনাথকেই বিয়ের অব্যবহিত পরে লেখা পত্রে এভাবে— ‘প্রতিমা এখন আমার। সে কী চমৎকার মেয়ে তোমাকে কী করে লিখি।’ স্বয়ং প্রতিমাকেই একবার লিখেছিলেন— ‘আমি কখনোই একজন কুশ্রী মেয়েকে সম্পূর্ণ ভালোবাসতে পারতুম না— আমার সে দুর্বলতা আমি স্বীকার করছি।’
১৯১৮-র ২২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর ভিত্তি স্থাপিত হলে রবীন্দ্রনাথের এই নতুন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে কবির আবার প্রয়োজন হলো রথীন্দ্রনাথকে। তিনি তখন অধীত কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা শিলাইদহে পৈতৃক জমিদারির কাজে হাতে-কলমে প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু তখনই আবার পিতার ইচ্ছায় শিলাইদহ ছেড়ে শান্তিনিকেতনে আসতে হল বিশ্বভারতীর কাজে পিতৃদেবকে সাহায্য করতে।
পালিতা কন্যা নন্দিনীর কথায়— ‘দাদামশাই থাকতেন তাঁর লেখাপড়ার কাজ নিয়ে। বাবা শান্তিনিকেতনের বৈষয়িক কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। তিনি নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে সরিয়ে রেখে শান্তিনিকেতনে দাদামশাইয়ের নতুন নতুন পরিকল্পনাকে রূপ দেবার জন্য সবসময় ব্যস্ত থাকতেন।’
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে— ‘রথীন্দ্রনাথের মেজাজটা ছিল বিজ্ঞানীর, মনটা ছিল আর্টিস্ট বা ভাবুকের। শিল্পী রথীন্দ্রনাথকে দেখা যায় উত্তরায়ন অট্টালিকা ও উদ্যান রচনায়। এখানেও বিজ্ঞানীকে পাই— যখন দেখি তাঁর উদ্যানের মাঝে গুহাঘরে যাবার পথে লতাবিতান। তিনি ছিলেন কারুশিল্পী, দারুশিল্পের যে-নমুনা তিনি বহু যত্নে বহু-কাল ধরে করেছিলেন, তা আজ কোথায় জানিনে।’ বিশ্বভারতীকে সুন্দর করে গড়বেন— এই ছিল রথীন্দ্রনাথের ইচ্ছা। কিন্তু তা পুরণ হয়নি। এক বিপুল দক্ষতা ও সম্ভাবনার আধার এই সংগঠক এবং কর্মকুশল ব্যক্তিত্বও একবার হতাশায় বলে ফেলেছিলেন— ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের। কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের’।
শান্তিনিকেতনের কাজে তিনি ক্রমে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন রবীন্দ্রছত্রছায়ায় অপরিহার্য হিসেবে। এমনকী শান্তিনিকেতনে তাঁর উপস্থিতি এতটাই জরুরি হয়ে পড়ত যে, কবির বিদেশভ্রমণকালে সঙ্গে যেতে পারতেন না। কবির যাত্রাসঙ্গী হতেন প্রায়শ পুত্রবধূ প্রতিমা।
কিন্তু হয়ত এভাবেই প্রতিমাদেবী ও রথীন্দ্রনাথের মধ্যে ক্রমে মানসিক দূরত্ব বৃদ্ধিই পেয়েছে পারিপার্শ্বিক কারণেও। দুর্ভাগ্যের, রবীন্দ্র-মৃণালিনীর সকল সন্তানেরই বৈবাহিক জীবনে ছিল ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো’। বাইশ বছর বয়সে ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ করা রথীন্দ্রনাথের দাম্পত্য জীবনও ছিল শীতল ও অসম্পূর্ণ। নিঃসন্তান প্রতিমাদেবী পালিতা কন্যা নন্দিনীকে বুকে টেনে নিলেও পরিণামে এ দাম্পত্যজীবন খুব একটা সুখের হয়নি। একটি চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ প্রতিমাদেবীকে লিখছেন— ‘আমি যে আদর্শ নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছিলুম তা ক্রমশই ভুলে গেছি বা হারিয়ে ফেলেছি।’
প্রসঙ্গত, দশ বছর বয়সী স্ত্রী আদরনীয়া ‘ছুটি’কে (মৃণালিনী) বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ লেখাপড়া শিখিয়ে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তোলার প্রয়াসী হলেও মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মৃণালিনীর প্রয়াণে কুড়ি বছরের জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে আরেকবার নিঃসঙ্গ হয়েছিলেন কবি— এ সত্য। তবে একথাও অনুমেয় যে মৃণালিনী হয়ত রবীন্দ্রনাথের মানসিক চাহিদা পূর্ণ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনার সম্যক উপলব্ধি বা তাঁর সূক্ষ্ম অনুভূতি স্পর্শ করা হয়ত মৃণালিনীর পক্ষে সম্ভব হত না। সেদিক দিয়ে হয়ত মৃণালিনীর সমবয়সী ভাইঝি ইন্দিরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মানসিক আদান-প্রদান সহজ হত। ইন্দিরার সঙ্গে আলাপনে হয়ত অধিকতর স্বছন্দ বোধ করতেন, নিজস্ব ভাবনা অনুভূতি প্রকাশে।
যাই হোক, রথীন্দ্র-প্রতিমার দাম্পত্যের এই ফাঁক স্থায়ীভাবে পুরণ হয়নি পালিতা কন্যা নন্দিনীকে পেয়েও। আর সেই অবসরে কখন যেন মনের গহীনে ক্রমে স্থান করে নিচ্ছিলেন বন্ধু ও বিশ্বভারতীর আশ্রম-অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা—বয়সের বেশ ব্যবধান থাকলেও। স্বাভাবিকভাবেই মীরার সঙ্গে এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি স্ত্রী প্রতিমাদেবী বা ভগিনী মীরা ও অন্যান্য আত্মীয়জনেরা।
যে রথীন্দ্রনাথ নিজের নবপরিণীতা স্ত্রীর কাছে অকপটে আপন অনুরাগ আবেগ প্রকাশ করেছিলেন তিনিই আবার সময়ান্তরে মীরাদেবীর স্বামী ও বিশ্বভারতীর অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যাকে লিখছেন নিজের সমস্ত আকুতি উজাড় করে— ‘আমার কেবল মীরু আছে— সেই-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড— তাকে আমার সবকিছু দিয়েছি—নিজেকেও সঁপে দিয়েছি।’
১৯৫১-য় বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে রথীন্দ্রনাথ হলেন তার প্রথম উপাচার্য। কিন্তু নানা বিতর্কে জড়িয়ে, ক্লান্ত অবসন্ন ক্ষুব্ধ বিরক্ত রথীন্দ্রনাথ পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন আচার্য জওহরলাল নেহরুর কাছে, যিনি চেয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ যেন বিশ্বভারতী থেকে আশ্রম-অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী মীরাকে বহিষ্কার করেন৷ কারণ এই মীরার সঙ্গে তাঁর (রথীন্দ্রনাথের) এক বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কারণে বিতর্কের সুত্রপাত হয়েছিল। ১৯৫৩-য় বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পর চিরকালের জন্য শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান দেরাদুনে, সঙ্গে প্রাণপ্রিয়া ‘মীরু’ (মীরা) ও তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে।
তিনি অবশ্য গোপনে কিছু করেননি— যা করেছেন অকপটে, নির্ভীকভাবে এবং ব্যতিক্রমী সততায় স্ত্রী প্রতিমাদেবীকে জানিয়ে। যাবার আগে প্রতিমা দেবীকে লিখলেন— ‘আমার পক্ষে একলা থাকা এখন আর সম্ভব নয়। মীরাকেও নিয়ে যাচ্ছি। তোমার ভাল না লাগলেও আশা করি আপত্তি করবে না। এতদিন আমাকে নির্বিবাদে সব লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। কারণ বিশ্বভারতীর সঙ্গে আমার যোগ ছিল। এখন আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন, তাই আমার নিজের স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করলে আমি সহ্য করব না। আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না, এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি, মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’
কিন্তু প্রতিমাদেবীর পক্ষে স্বামী রথীন্দ্রনাথের জীবনে মীরাকে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। রথীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ত্যাগের অব্যবহিত পরেই তিনি লিখলেন— ‘কী মতিভ্রম হল, নিজের কাজকর্ম সব ছেড়ে ওই একটা অতি অর্ডিনারি টাইপের মেয়ের সঙ্গে চলে গেলেন, মানুষের কত পরিবর্তন হয় তাই ভাবি’।
তবে শান্তিনিকেতনের তৎকালীন আবহে বীতশ্রদ্ধ ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির এক উজ্জ্বল কৃষিবিদ ও বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিনের বন্ধু ও এক সময়ের সহকর্মী লিওনার এলমহার্স্টকে লিখেছিলেন তখন এক পত্রে— ‘আমি পলায়নকারী নই। আমি নির্জনতার মধ্যে যাচ্ছি, কারণ আমি নিজেকে আবিষ্কার করতে চাই, আর চাই কোন সুপ্ত প্রেরণাকে সুযোগ দিতে, যা কিছু তৈরির অপেক্ষায় রয়েছে।’
তাঁর সে অভীপ্সা কতখানি সফল হয়েছে, জীবনের শেষ আটটি বছর বন্ধু আশ্রম-অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরার সঙ্গে দেরাদুনে নিজের শখের তৈরি শান্তিনিকেতনের বাড়ির প্রতিরূপ ‘মিতালী’তে যাপনকালে তা বলা সম্ভব নয়। তবে তাঁর জীবনের এই অধ্যায়ের জন্য তাঁকে হয়ত মূল্যও দিতে হয়েছিল। রূঢ় বাস্তব হল, শান্তিকেতন ত্যাগের পর মাঝে মধ্যে সপুত্র মীরাকে নিয়ে সেখানে এলেও ১৯৬১-তে রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে বিশ্বভারতী থেকে আমন্ত্রণ পাননি, যিনি কবির উত্তরাধিকারী বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য হিসেবে শান্তিনিকেতনে ও বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র ভাবনা ও দর্শনকে রূপ দিতে আন্তরিক প্রয়াসী ছিলেন।
অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথায়— ‘রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবন লোকচক্ষুর অন্তরালে কাটিয়েছেন। কোনকালে এতটুকু আত্মপ্রচারের চেষ্টা করেননি। বস্তুত রথীদা যতদিন বিশ্বভারতীর সর্বময় কর্তা হয়ে ছিলেন ততদিন কখনও পরের চাকুরী করছি এ অনুভুতি হয়নি।’ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে— ‘ভবিষ্যতে যদি একদিন রবীন্দ্র ভবন, রবীন্দ্রজীবনীর ও রবীন্দ্র সাহিত্যের তাত্ত্বিক গবেষণার কেন্দ্র হয়, তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এর মূলে ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। এই রবীন্দ্রভবনের সার্থকতাতেই পরোক্ষে রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিরক্ষা হবে।’ আবার পুলিন বিহারী সেনের মতে— ‘তবে কঠিন সমালোচনার ফলে (রথীন্দ্রনাথ) যতই পীড়া বোধ করে থাকুন , বাক্যে বা ব্যবহারে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ধৈর্য তাঁকে রক্ষা করতে হয়নি; ধৈর্য তাঁর সহজাত ভূষণ ছিল।’
এই নিঃসঙ্গ ব্যতিক্রমী মানুষটি যিনি অনেক গুণের আধার হয়েও তেমনভাবে সফল বা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি হয়ত ভাগ্যবিড়ম্বনায়। যা হোক, সেবছর রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনের মাসখানেকের মধ্যেই ৩ জুন তাঁর প্রয়াণ ঘটে দেরাদুনেই। এই মৃত্যু ঘিরেও সন্দেহ ও প্রশ্ন দানা বেঁধেছিল ঘনিষ্ঠ আত্মীয়মহলে, যদিও ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লেখ ছিল অন্ত্রের সমস্যার কারণেই মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু তখনও একমাত্র জীবিত ভগিনী মীরা ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায় কন্যা নন্দিনীকে লিখেছিলেন এক পত্রে— ‘সময়মত রোগের চিকিৎসা করেনি তাও তো যে শুনছে সেই-ই বলছে। কিন্তু সত্যি কি ওরা কিছু খাইয়ে মেরে ফেলেছে? শেষকালে এই ছিল কপালে।
ওদের সবই তো দিয়েছিলেন ,তবু প্রাণে মারল কেন?’ প্রসঙ্গত, পালিতা কন্যা নন্দিনী, রথীন্দ্রনাথের বড় আদরের পুষুমনি, পরিণত বয়সে বাবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে অটুট শ্রদ্ধায় লিখেছেন— ‘বাবার কাছ থেকে অনেক পেয়েছি। তাঁর জীবনাবসানের সঙ্গে আমি যে কতখানি অসহায় বোধ করেছি এবং এখনও করছি সে কথা বলে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই।’ ২৭ নভেম্বর সেই ব্যতিক্রমী কিঞ্চিৎ বিতর্কিত ও নিঃসঙ্গ কিন্তু পরম গুণী মানুষটির ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী।