অগুন্তি মানুষের প্রাণহানির বিনিময়ে যে দেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশ আবার অগ্নিগর্ভ— রাজধানী ঢাকা উন্মত্ত জনতার হাতে চলে গিয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যু সংবাদ গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় পৌঁছনোর পরপরই মঞ্চের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। তাদের রোষে পড়ে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদপত্রের অফিস ও ঢাকায় অবস্থিত ভারতের হাই কমিশনের অফিস। হাদির মৃত্যুর খবর ঢাকায় পৌঁছলে, তাঁর সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অশান্তি ছড়াতে পারে ভেবে তদারকি সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীকে সংযত থাকতে আহ্বান জানান। কিন্তু ইনকিলাব মঞ্চের সমর্থকরা তাঁর কথার কোনও গুরুত্ব না দিয়ে রাস্তায় নেমে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সম্প্রতি হাদি ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের তাঁকে বাঁচানোর সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও হাদি মারা যান।
হাদির দেহ ঢাকায় আনার পর উন্মুক্ত জনতা তাণ্ডব শুরু করে দেয়। তারা ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’-এ গিয়ে ভাঙচুর শুরু করে। ‘ভারতের দালাল’ স্লোগান দিয়ে তারা মূল্যবান বাদ্যযন্ত্র, তবলা, হারমোনিয়াম, তানপুরা ভেঙে রাস্তায় ফেলে দেয়। ছায়ানটের সঙ্গীতের মূল্যবান কাগজপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ছায়ানট পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে রমনার বটমূলে। কয়েক বছর আগে এই অনুষ্ঠান চলাকালীন আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন ছায়ানটের সদস্যরা। তা সত্ত্বেও, ছায়ানট প্রতিবছরই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান উদযাপন করে এই রমনার বটমূলে। প্রচুর জনসমাগম হয় ছায়ানটের অনুষ্ঠানে। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। এবার ছায়ানটের আক্রমণ ভয়াবহ— প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি সত্ত্বেও ছায়ানটের সদস্যরা ভাঙা যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রতিবাদের গান গেয়েছেন।
উন্মুক্ত জনতার হাত থেকে রেহাই পায়নি ঢাকার দু’টি বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ এবং ‘ডেইলি স্টার’-এর অফিস। বিক্ষোভকারীরা এই দু’টি সংবাদপত্রের অফিসে চড়াও হয়ে ভাঙচুর চালায়। উভয় কাগজের কর্মীরা, সাংবাদিকরা পথে নেমে প্রদিবাদ জানান। তাঁরা ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছায়ানট এবং সংবাদপত্রের অফিসে ভাঙচুরের ঘটনার নিন্দা জানান। অভিযোগ, যখন সংবাদপত্র দু’টি অফিসে বিক্ষোভকারীরা চড়াও হয়, তখন পত্রিকা দু’টির কর্মকর্তারা পুলিশের সাহায্য চান, কিন্তু পুলিশের সাহায্য পাওয়া যায়নি। বিক্ষোভকারীরা ভারতের হাই কমিশনের অফিসে জমায়েত হয়ে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নানা বিদ্বেষমূলক স্লোগান দেয়।
ময়মনসিংয়ের এক সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে গাছে বেঁধে ব্যাপক প্রহার করে— ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। তারপর তাঁকে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বিপন্ন বোধ করেন। তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ইনক্লাব মঞ্চের একদল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানের ভাঙা বাড়িতে গিয়ে বাড়ির অবশিষ্ট অংশ ভেঙে ফেলে। তার অর্থ তারা মুজিবুর রহমানের অস্তিত্ব বিলোপ করতে চেয়ে উস্কানিমূলক নানা স্লোগান দেয়। তারা স্লোগান তোলে ভারতের বিরুদ্ধে, ‘ভারতের দালাল দূর হটো’। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ এখন কোন পথে চলছে? আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন৷ ঢাকার বিশিষ্টজনেরা আশঙ্কা করছেন, এই নির্বাচন আদৌ হবে কিনা, বর্তমানে বাংলাদেশে যে ধরনের ধ্বংসলীলা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন যদি হয়ও, তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে কিনা। বাংলাদেশে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যদের হিংসা ছড়ানো একটি অশুভ সংকেত বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যে ধ্বংসলীলা চলছে তার তীব্র নিন্দা করে ভারতের বিদেশমন্ত্রক বলেছে, যেভাবে একজন শ্রমিক দীপু দাসকে মেরে তাঁর দেহ গাছে ঝুলিয়ে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এই ঘটনাটি ভয়াবহ।
ভারত সরকার বলেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ বর্তমান ইউনূস সরকার। বাংলাদেশের নির্বাচন বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আদৌ শান্তিপূর্ণ হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনের আগে সেখানে ভারতবিরোধী জিগির তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশের এক নেতা বলেছেন, হাদির মৃত্যুর পর যা হল তা পুরোপুরি পরিকল্পিত। আর গোটা ঘটনাই ঘটল ইউনূস নেতৃত্বে থাকাকালীন। এই অনভিপ্রেত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে কিনা, তা নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।