প্রথম রবীন্দ্র-পুরস্কারপ্রাপকের চোখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসাধারণেও সাধারণ

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫০)-এর প্রথম প্রাপকদ্বয়ের একজন সতীনাথ ভাদুড়ী, অন্যজন নীহাররঞ্জন রায়। ফলে একথা অনায়াসেই বলা যেতে পারে সতীনাথ বাংলা কথাসাহিত্যে প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত অন্যতম লেখক। যে বইটির জন্য সতীনাথ পুরস্কারটি পেয়েছিলেন, সেই ‘জাগরী’ (১৯৪৫) উপন্যাসটি তার আগেই প্রজ্ঞাভারতী নামক এক প্রতিষ্ঠান থেকে আলোকরঞ্জন-স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। পরে প্রখ্যাত সমালোচক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক অতুলচন্দ্র গুপ্তের তৎপরতায় রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্তিতে স্বাভারিকভাবে সতীনাথের লেখক-পরিচিতি বেড়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন মারা যান, তখন সতীনাথের বয়স পঁয়ত্রিশ পেরোনোর পথে। তারও বছর তিনেক পরে সতীনাথ ভাগলপুর জেলে বসে ‘জাগরী’ লিখেছেন। ফলে সহজেই অনুমেয় যে সতীনাথ রবীন্দ্রসান্নিধ্য না পেলেও রবীন্দ্র আবহে বড় হয়েছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনাচিন্তা আপনাতেই গড়ে উঠেছিল।

সতীনাথ যেমন বহুভাষী ছিলেন, তেমনই বহুবিষয়েও পড়াশোনা করতেন। সিরিয়াস পাঠক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। অথচ পাণ্ডিত্য তাঁর ভাবনাকে কখনও অযথা জটিল করে তোলেনি। বরং তাঁর রচনায় সূক্ষ্ম রসবোধের অভাবনীয় পরিচয় রয়েছে। তাঁর রচনাবলিতে সংকলিত বত্রিশ বছরের (১৯৩১-১৯৬২) মাত্র ১১টি ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধই মৌলিক চিন্তাচেতনায় উপাদেয় হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর ভাবনাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর ‘হায় রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধটি তার উজ্জ্বল নিদর্শন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি গতানুগতিক মূল্যায়নের পথে হাঁটেননি। সতীনাথ রবীন্দ্রনাথকে যেমন অন্ধভক্তিতে মহান করে তোলেননি, তেমনই অতিবিচক্ষণতায় দোষত্রুটি খুঁজে বের করে হেয় করার প্রচেষ্টা চালাননি।

তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ নানা ক্ষেত্রের প্রতিভাবানদের মতো ‘কাব্য উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ বাদ্য সংগীত’ এমনকি ‘ছবি আঁকা’-র ক্ষেত্রে প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু অন্য অনেক প্রতিভাশালীর ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ থাকলেও সতীনাথ রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সেই যোগাতা না পেয়ে নিরাশ হয়েছেন। বিষয়টি তিনি প্রবন্ধের সূচনাবাক্যেই তুলে ধরেছেন, ‘কেউ জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে যত প্রতিষ্ঠাই অর্জন করুন না কেন, আমার মনের দরবারে আসন পেতে তাঁকে অন্তত আর একটি বিষয়ে ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ দেখাতে হবে’ কেননা তাঁর মনে হয়েছে: ‘ন্যায্য পাওনার চেয়েও বেশি চাইবার দিকে মনের একটা প্রবণতা আছে। মাইনের উপর চাই উপরি, জিনিস কিনে চাই ফাও; তাই যোগাতার উপরও আশা করি ‘অতিরিক্ত যোগাতা’র, সেদিক থেকে তিনি অনেকদিন পরে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বেহালা বাজানোতে এবং অনায়াসে দিনেমারের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী নীলবোরের আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় দেশের টিমে স্থান পাওয়ার মধ্যে সেই যোগ্যতা খুঁজে পেয়ে মন ভেজাতে পেরেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তার অন্যথা হওয়ায় তাঁর মন অনেকদিন থেকেই মুষড়ে পড়েছিল। এসব শুনে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে এসব ভাবনায় সতীনাথের অসুস্থ মানসিকতাই দায়ী। আদতে কিন্তু তা নয়। সতীনাথ অত্যন্ত সুশিক্ষিত এবং সচেতন শিল্পী। তিনি নিজের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। তাঁর বক্তব্য ক্রমেই পরিস্কার হয়ে ওঠে।


সতীনাথ অনেক ভেবে শেষে নিজের তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের একটি ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র হদিস পান। তিনি জানিয়েছেন: ‘গাছপালার উপর আমার ঝোঁক চিরকালের। তাঁর মধ্যেও সেইটা খুঁজে বার করবার চেষ্টা করতে লাগলাম।’ সেজন্য তিনি সফলও হন, কিন্তু সেই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বনবীণা’ (১৩৩৮) কাব্যের ‘নীলমণিলতা’ কবিতাটির সুচনায় শান্তিনিকেতনের বাগানে ‘পরলোকগত বন্ধু পিয়ার্সনের’ লাগানো বিদেশি গাছের চারাটি ক্রমে অজস্র নীলফুলে আত্মপ্রকাশের শোভায় বিমুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন। সেজন্য কবি এই নামহীন লতাটির নামকরণে এগিয়ে আসেন। তাঁর মনে হয়েছিল: ‘আমার দিক থেকে কবির বলবার ইচ্ছে হত, কিন্তু নাম না পেলে সম্ভাষণ করা চলে না। তাই লতাটির নাম দিয়েছি নীলমণিলতা। উপযুক্ত অনুষ্ঠানের দ্বারা সেই নামকরণটি পাকা করবার জন্যে এই কবিতা।’

রবীন্দ্রনাথের এই নামকরণের মধ্যেই সতীনাথ তাঁর অতিরিক্ত যোগ্যতা খুঁজে নেন। তাঁর মতে অনেককিছুই রবীন্দ্র নামকরণে আশীর্বাদপুষ্ট হলেও ‘কিন্তু আমার জানা ফুলের লতার নাম দেওয়া তাঁর এই প্রথম’। সেজন্য তিনি আরও জানিয়েছেন: ‘বুঝে গেলাম যে উদ্যান সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশেষজ্ঞ। নীলমণিলতা কবিতাটি পড়বার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র দাবি মঞ্জুর করে দিলাম।’ আবিস্কারের আনন্দে সতীনাথ মেতে উঠে ফুলগাছের ল্যাটিন নামের শেষে যেমন একজন সাহেবের নাম জুড়ে দেওয়া থাকে, তেমনই তিনিও নীলমণিলতাটির নাম দিলেন ‘নীলমণি রবীন্দ্রাণী’। তবে তাঁর এই নামকরণ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ তাঁর মনের রবীন্দ্রনাথের গাছপালা বিশেষজ্ঞ মূর্তিটি অচিরেই ভেঙে পড়ে।

সতীনাথের মনে নীলমণিলতার মধ্যে দিয়ে আরও বেশি করে রবীন্দ্রনাথকে নিবিড় করে পাওয়ার জন্য লতাটি নিজের বাগানে পোঁতার সাধ জেগে ওঠে। সেজন্য তিনি শান্তিনিকেতনের বন্ধুকে চিঠি লিখে গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম জানার চেষ্টা করেন এবং জানতে পারেন, লতাটির নাম ‘petrea volublis’। সেই নাম জেনেই সতীনাথের এতদিনের পোষিত ধারণা ভেঙে যায়। তাঁর ছোটবেলা থেকে অতিপরিচিত পেট্রিয়া ফুল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মাতামাতি মনঃপূত হল না। সেজন্য তাঁর মনে হয়েছে, ‘হায় রবীন্দ্রনাথ! আমার বাগানের মালী যা জানে তুমি তাও জানো না!’ ফলে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘সবেধন নীলমণি’র ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’র সার্টিফিকেটটি বাতিল করেই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে ‘কত কষ্টে ফাঁপানোফোলানো বেলুনটিকে’ এভাবে চুপসে দেওয়ার প্রতিশোধস্বরূপ সজনে ফুলের নাম দিয়েছেন ‘সজিনা রবীন্দ্রিয়ানা’।

প্রবন্ধটি সূক্ষ্ম কৌতুকরসে শেষ হলেও স্বাভাবিকভাবেই মনে আসবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সজিনা ফুলের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। সতীনাথ অবশ্য প্রবন্ধটির মধ্যে জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ সজনের ফুলকে জাতে তোলেন। কেমন জাতে তোলেন বিষয়টি একটু আলোচনা প্রয়োজন। কেননা রবীন্দ্রনাথ সজনে ফুল নিয়ে সেভাবে কোনো সাহিত্যসৃষ্টি করেননি। তবে তিনি তাঁর ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধে বরং সেই ফুলের সাহিত্যে অব্যবহারের মূলটি তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে ‘যে-মন বরণীয়কে বরণ ক’রে নেয় তার শুচিবায়ুর পরিচয় দিই। সজনে ফুলে সৌন্দর্যের অভাব নেই। তবে ঋতুরাজের রাজ্যাভিষেকের মন্ত্রপাঠে কবিরা সজনে ফুলের নাম করেন না। ও যে আমাদের খাদ্য, এই খর্বতায় কবির কাছেও সজনে আপন ফুলের যাথার্থ্য হারাল।

বক ফুল, বেগুনের ফুল, কুমড়ো ফুল, এই-সব রইল কাব্যের বাহির-দরজায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে; রান্নাঘর ওদের জাত মেরেছে। কবির কথা ছেড়ে দাও, কবির সীমন্তিনীও অলকে সজনে-মঞ্জরি পরতে দ্বিধা করেন’। তবে রবীন্দ্রনাথ এও জানিয়েছেন, ‘আমি নিজে জাত-মানা কবির দলে নই, তবু বাঁশবনের কথা পাড়তে গেলে অনেক সময় বেণুবন ব’লে সামলে নিতে হয়।’ ফলে সজনে ফুলকে কবি জাতে তুলেছেন বলে মনে হয় না। আসলে ‘সজিনা রবীন্দ্রিয়ানা’র মধ্যে ‘শনিবারের চিঠি’র প্রখ্যাত সম্পাদক-সমালোচক সজনীকান্ত দাসের কলমের আঁচড়ে রবীন্দ্রনাথের মসীলিপ্ত ভাবমূর্তিকেই সতীনাথ সুকৌশলে কৌতুক সৃষ্টি করেছেন। ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ না থাকার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছোট করেননি। বরং বড় করেই তুলেছেন। সজনীকান্ত যেমন প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে না পেরে সমালোচনায় মুখর হয়ে পরে তাঁর প্রগাঢ় ভক্ত হয়েছিলেন, তিনিও তেমনই রসিকতার মোড়কে সেই ভুল সচেতনভাবে করেছেন। সেদিক থেকে তাঁর মূল্যায়নে অবমূল্যায়ন ঘটেনি।

সতীনাথ রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচেতনা সম্পর্কে কতকগুলি প্রশ্ন তুলেছেন। সেগুলির মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর ভাবনাচিন্তার আকর খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, ‘ঋতুরাজের রঙ্গলীলায়, প্রকৃতির সত্যিকার রূপের চেয়ে, তার বেশভূষার উপর কবির নজর বেশি না কি?’ তাঁর ‘আবছাভাবে’ আরও মনে হয়েছে ‘সেখানে বেশের চেয়েও ভূষার উপর রবীন্দ্রনাথের টান বেশি।’ এছাড়া অন্য অনেকের মতো সতীনাথেরও মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ পদ্মা অত্রাই গরাই নদীর চরের মাটির রূপ-রস ও গন্ধ শুষে টেনে নিলেও তাঁর কাব্য-গানে মাটির গন্ধ পাওয়া যায় না। তাঁর আরও মনে হয়েছে, ‘জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভ রভসে’র মধ্যে মাটির গন্ধ পাই না কেন?’ অবশ্য কবি তাঁর ঐক্যতান কবিতায় পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, ‘আমার কবিতা জানি/ আমি গেলেও / বিচিত্র পথে সে হয় নাই সর্বত্রগামী।’ আবার প্রখ্যাত রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ প্রমথনাথ বিশীর মতে রবীন্দ্রসাহিত্যের তিন জগতের একটি ‘প্রকৃতি’।

সেই জগৎটি সম্পর্কে কবি যে অত্যন্ত সচেতন শিল্পী ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। তাই বলে সতীনাথের অনুযোগগুলো অসার হয়ে যায় না। তিনি তাঁর অধিকার বলেই রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নে ব্রতী হয়েছেন। রবীন্দ্র বৃক্ষপ্রীতি ও কুসুমপ্রেমের প্রশংসা তিনি যেমন জেনে করেছেন, তেমনই তাঁকে আবেগসর্বস্বতায় মহান করে তোলেননি। ফলে তাঁর রবীন্দ্রভাবনা যেমন গতানুগতিক পথে এগিয়ে যায়নি, তেমনই তা মৌলিক চিন্তনের খোরাক হয়ে উঠেছে। সতীনাথ রবীন্দ্র মূল্যায়নের একটি অভিনব মাপকাঠির হদিস দিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি মানবিক প্রতিকৃতি তুলে ধরে আমাদের ভাবনার জগৎটিকে নাড়া দিয়েছেন। এমনকি, তাঁর অনুযোগের ভিত্তিগুলিকে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে মেলে ধরে সফলও হয়েছেন। তাই তাঁর ভাবনার মধ্যে ফাঁক থাকলেও ফাঁকি ছিল না। সেজন্য তাঁর চোখে রবীন্দ্রনাথ ভক্তির পরাকাষ্ঠায় দেববিগ্রহ হয়ে যাননি, অসাধারণ হয়েও সাধারণে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন।