শান্তনু রায়
প্রথমে শ্রীলঙ্কা-তারপর বাংলাদেশ-শেষে নেপাল। জনবিক্ষোভের (দৃশ্যত জেন জি-র বিক্ষোভ) কারণে ভারতের প্রতিবেশি এই দেশগুলিতে অস্থিরতা অশান্তি ও জোরপূর্বক সরকার পতন-হিংসা নৈরাজ্য ভারতের পক্ষে উদ্বেগের বিষয় কারণ এর ফলে কেবল দেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নতা জাগেনা ,প্রতিবেশির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ে। এভাবে সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে মোটামুটি এই সুরে শঙ্কা প্রকাশ করেও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবতও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বলেছেন- সরকার জনগণের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কিংবা তাদের সমস্যার বিষয়ে অন্ধকারে থাকলে জনগণ সরকার বিরোধী হয়ে ওঠে। তবে জনসাধারনের ক্ষোভের সহিংস বহিঃপ্রকাশের কারণে ভারতের সীমান্তে থাকা দেশগুলিতে এইভাবে পরিবর্তনের অন্তরালে তিনি বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। শ্রীভাগবতের এই অভিমত নিছক আরএসএস প্রধানের ভাষ্য হিসেবে মতাদর্শগত বিরোধিতার দৃষ্টিকোন থেকে বিচার না করে হয়ত সুস্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে এক চেতাবনি হিসেবেও গ্রহণ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে যে সরকারি নীতির সঙ্গে তীব্র মতবিরোধ থাকলেও দিনের শেষে এও সত্য যে আমরা এইদেশে বাস করি, করতে হবে, এর সার্বভৌমত্ব, ভৌগলিক সীমারেখা বিঘ্নিত হলে আমরাও অনাক্রান্ত থাকব না, শান্তিতেও না।
প্রসঙ্গত ইতিমধ্যে আরেকটি দেশ, দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারেও বিদ্যুত ও জলসংকটকে কেন্দ্র করে জেন জি-র হিংসাত্মক বিক্ষোভের জেরে দাঙ্গা লুটপাট ও কমপক্ষে ২২ জনের মৃত্যু ঘটলে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রি বাজোয়েলিনা প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে সরকার ভেঙ্গে দিলে সরকারের পতন ঘটল। যদিও সেদেশে বিক্ষোভ থেকে শ্লোগান উঠেছে বাজোয়েলিনা হটাও ।
যাই হোক, পড়শি দেশ নেপালের অবস্থার দিকে নজর দিলে দেখা যায় সেদেশের শীর্ষ আদালতের অবসর প্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি যিনি দেশের প্রথম মহিলা বিচারপতিও বটে, তাঁকেই হাল ধরতে হয়েছে অগ্নিগর্ভ পড়শি দেশ নেপালের। আরেক পড়শি বাংলাদেশের গত বছরের ঘটনাবলীর সঙ্গে এখানে একটা মিল হয়ত খুঁজে পাওয়া যায়- উভয় দেশেই রাজনীতির বাইরের লোককে এনে বসানো হয়েছে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অবস্থা সামাল দিতে। এর ফলাফল যে সব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে সুখকর হয় না তার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন পুবের পড়শি দেশ, এখন ‘হিমালয়ের দেশ’-এ নৈরাজ্য ও অচলাবস্থা দূরীকরণে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক শীর্ষে অন্তর্বর্তী দায়িত্বে বসানো কতখানি ফলপ্রসু হবে তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই নেপালের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকি অবশ্য আগামী মার্চে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছেন। সেদেশের এই আকস্মিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন বিশ্বের সামনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আরও কিছু জটিল মোড় নিতে পারে এশিয়ার এই অংশের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। প্রথম দিকে এ বিক্ষোভ আন্দোলন জেন জি-দের স্বতস্ফুর্ত মনে হলেও জঙ্গি বিক্ষোভকারীদের আচরণে অনেক প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। প্রশ্ন জাগছে এই বিক্ষোভ বিদ্রোহের আসল কারণ কী?
ওলি সরকারের সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি আপাতভাবে ছাত্র জনতার বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠার কারণ মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে বহু বছর ধরে পুঞ্জিভূত অসন্তোষ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হল জেন জি’দের এই আন্দোলন৷ পর্দার আড়ালে কোন বহিঃশক্তির গোপন ইন্ধনের কথা অস্বীকার এই মুহূর্তে জোর গলায় বলার মত অবস্থা নেই। এ প্রসঙ্গে বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কায়, ২০২৪-এ পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনগণের একাংশের ক্ষোভ অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে কোন এক বহিঃশক্তির মদতে ‘মেটিকুলাস ডিজাইনে’ সেদেশের চরম মৌলবাদী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘটনার সমাপতন এই যে আগস্টের ৫ তারিখেই অনেকদিন পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে জামাতি ইসলামের ছাত্র শিবির বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছে। ছাত্র লীগ ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু নির্বাচনে যোগ দিয়ে বিএনপির ছাত্র সংগঠন মোটেই সুবিধা করতে পারেনি। বোঝা যাচ্ছে হাসিনা বিদায়ের পর বিএনপি সহজেই ক্ষমতায় চলে আসবে ভেবে ধরাকে সরা জ্ঞান করে দেশের সর্বত্র চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিতে নিমগ্ন হয়েছে আওয়ামী লীগের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে সাংগঠনিক শক্তির জোরে। অন্যদিকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থানের জন্য জামাতি ইসলাম দল স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে জন-নিন্দিত ও বৃহত্তর পরিসরে পরিত্যাজ্য হলেও গোপনে শক্তিসঞ্চয় করতে থাকে মুজিব পরবর্তী সেদেশে। ২০০১-এ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে
বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এলে জামাতের সংগঠন বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ এসে যায়। সেসময় একদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাত সমর্থক এবং সক্রিয় কর্মীদের শিক্ষক পদে নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় মতাদর্শ বিস্তারের মাধ্যমে আধিপত্য কায়েমের বীজ বপন করা শুরু হয়। অন্যদিকে দেশে জেহাদি আদর্শের আঁতুড়ঘর হিসেবে বেশি বেশি করে মাদ্রাসা স্থাপনে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। ২০০৪-এর ১২ আগস্টের সেদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ য় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও বিষয়টি নিয়ে পরিসংখ্যান-সহ বিস্তারে আলোচিত হয়েছিল। সেই রোপিত বিষবৃক্ষের ফলই আজ বাংলাদেশের সর্বত্র। যারা গর্তে লুকিয়েছিল এক সময় তারাও এখন বেরিয়ে দাঁত নখ দেখাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল সেই অশুভ শক্তির গোপনে বলসঞ্চয়ে ভিত গড়ার ফলের ইঙ্গিত দেয়।
নেপালের ক্ষেত্রে অবশ্য পরিস্থিতি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। বাংলাদেশের মতো নেপালে সরকার পতনের পরও তেমন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। একথাও মনে রাখতে হবে যে সেদেশে রাজতন্ত্রের অবসানের পর চিনপন্থী কমিউনিস্ট শক্তিই ক্ষমতার রাশ হাতে রেখেছিল। ক্ষমতার অলিন্দে পরিবর্তন হয়েছে বারবার এবং প্রচুর মানুষও প্রাণ হারিয়েছেন ইতিমধ্যে। দীর্ঘদিন কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় থাকলেও লাগামছাড়া দুর্নীতির ফলে দেশবাসী ক্ষুব্ধ তিতিবিরক্ত। একথাও স্মর্তব্য, নেপালে ১৯৯৬-২০০৬ দীর্ঘকাল রাজতন্ত্র উৎখাতের আন্দোলনের ফলে রাজতন্ত্র হটিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন হলেও কোনও সরকারই স্থায়ী হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল দেশের সাধারণ মানুষ পাননি-তারা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন যে তারা প্রতারিত হয়েছেন। একথা মনে রাখতে হবে নেপালে অন্যতম গুরুতর সমস্যা বেকারী। তার সাথে লাগাম ছাড়া দুর্নীতি। এর সাথে আছে সাধারণের ক্ষোভে ইন্ধন দিয়ে বৃহৎ শক্তির গোপন কলকাঠি নাড়া। যা জেন-জিদের সাম্প্রতিক বিদ্রোহের পেছনে এটি ও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
প্রসঙ্গত একদা নেপাল ঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্র হলেও ২০০৭ সালে এটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত৷ সেদেশে সব ধর্মের মানুষের জন্য ধর্মাচরণের স্বাধীনতা রয়েছে। তবে এবারের বিক্ষোভের মাঝে রাজতন্ত্রে বা ধর্মীয় রাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার দাবিও গুঞ্জরিত হয়েছে। কিন্তু বোধকরি অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত কর্তব্য হবে ২০১৫ সালের সংবিধান অনুসারে দেশকে সুস্থ সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
নেপালের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নেপালি কংগ্রেস ও নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি ( ইউএমএল)। নেপালি কংগ্রেসের সাথে এদেশের কংগ্রেসের সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। বিজেপির সঙ্গেও সমীকরণ অমধুর নয়। যদিও চিনপন্থী প্রচণ্ড এবং পরবর্তী ওলি দুই সরকারের আমলে সেদেশের রাজনীতিতে চিনের প্রভাব ক্রমে বেড়েছে। এশিয়ায় চিনের প্রধান ও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। নেপালের পশ্চিম সীমান্তে কিছু এলাকা নিয়ে ভারতের সাথে নেপালের সীমান্ত বিরোধ আছে। দু’দেশের মধ্যে অনেকটাই খোলা সীমান্ত আছে। স্বাভাবিকভাবেই আছে সীমান্ত-অনুপ্রবেশের সমস্যাও। সেকারণে অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে নেপালের সরকার পতনের পরপরই সেদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে প্রধানমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক বসে।
পাকিস্তানের পর চিনের নতুন ক্রীড়নক নেপালের ওলি সরকারের উদ্যোগে ভারতের তিনটি অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে নেপালের নতুন মানচিত্রটি সম্প্রতি অনুমোদিত হয়েছে সেদেশের সংসদের উচ্চকক্ষেও, ভারতের আপত্তি অগ্রাহ্য করে। প্রসঙ্গত বছর কয় আগে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপন্ন ওলি সরকারের পাশে চিন দাঁড়ানোয় সে যাত্রায় বেঁচে যাওয়া ওলি সরকার চিনের এমনই বশংবদ হয়ে পড়ে যে সেদেশ আমেরিকার আর্থিক অনুদানের মত প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিতে পিছপা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকা এতে খুশি হয়নি। আবার চিন প্রভাবিত ওলি সরকার মাঝে মাঝেই ভারতের সাথেও পায়ে পা দিয়ে দ্বৈরথে যাবার উস্কানি পেয়েছে চিনের কাছ থেকেই।
প্রসঙ্গত ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় আমেরিকার মত কমিউনিস্ট চিনও ছিল স্বৈরাচারী পাকিস্তানের পাশে। রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচারের প্রশ্নে মায়নামার সরকারকে সমর্থন করেছে খোলাখুলিভাবে। আর্থিক সহায়তা দানের বিনিময়ে শ্রীলংকায় ইতিমধ্যেই চিন ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে।
চিন এর আগে ভারত মহাসাগরে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে মালদ্বীপের স্বৈরাচারী ও চিনপন্থী হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট যিনি সে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সবরকম প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টিকারী তাকে নির্লজভাবে সমর্থন যুগিয়েছে আপনস্বার্থে- ওই প্রেসিডেন্টের সাথে এক চুক্তি মোতাবেক মালদ্বীপের উত্তরদিকে এক যৌথ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (নৌঘাঁটি) স্থাপনের সুবিধা নেওয়ার প্রতিদানে। সেদেশে ‘ইণ্ডিয়া আউট’ নামে এক ভারতবিরোধী আন্দোলনের আবহে গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে অভ্যুত্থানের প্রতি সংহতি জানিয়েও বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে ।
সন্ত্রাস ও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে আর্থিক ঋণের টোপ দিয়ে সেদেশেও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনেও তৎপর চিন। যেমন বাংলাদেশেও ভারতবিরোধী শক্তির সাহায্যে সেদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে আর্থিক ঋণের জালে জড়িয়ে। গোড়া থেকেই এশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্যের অভিলাষী স্বৈরাচারী চিনের কাছে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ।
বিশ্ববাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তারের অঙ্গ হিসেবে এদেশেরও অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চিনের কিছু পদক্ষেপে সতর্ক ভারত কিছু নিবারণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় চিন না-খুশ হয়েছে। চিনা সংস্থাকে দেওয়া বরাত রেলমন্ত্রকের বাতিল করা ছাড়াও বিএসএনএলকেও চিনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ এবং ৫৯টি চিনা অ্যাপ ভারত সরকার এদেশে নিষিদ্ধ করায় নিঃসন্দেহে চিনের কপালে ভাঁজ পড়েছে।
আগেই উল্লেখিত এশিয়ায় ভারত চিনের চির প্রতিদ্বন্দ্বী। ট্রাম্পের আগের জমানায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের পর আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক জোরদার হয়েছে অনুমানে চিন ছিল কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জি-৭ গোষ্ঠীকে বর্ধিত করে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব চিন সহজভাবে নিতে পারেনি, প্রতিদ্বন্দ্বী বিশেষ সম্মান ও গুরুত্ব পেয়ে গেলে চিনের এশিয়ায় বড়দাদার ভূমিকা পাছে খর্ব হয় এই আশংকায়।
তবে মনে রাখতে হবে মাঝে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হলেও আমেরিকা ভারতের স্বাভাবিক বন্ধু নয়, কিন্তু আগ্রাসী চিনকে ঠেকাতে আমেরিকার নিজের স্বার্থেই ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখা দরকার। বাইডেনের আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্কের উষ্ণতা অনুভব করা না গেলেও দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার আগে ট্রাম্প সাহেবের বচনে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্নতির কিছুটা প্রত্যাশা জেগেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যের, পহেলগাম ঘটনার জেরে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হলে ব্যবসায়ী ট্রাম্প রহস্যজনকভাবে হঠাৎ ‘শান্তির অবতার’ হয়ে পাকিস্তানের মুখ রক্ষায় অতি সক্রিয় হয়ে যুদ্ধবিরতি ঘটাতে নেমে পড়েছিলেন। এমনকি পাকিস্তানের যুদ্ধবাজ সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে স্বয়ং ট্রাম্পের একাধিক বৈঠক সহ পাকিস্তানের মুখ বাঁচাতে সম্প্রতি আমেরিকার আচরণ ও বিভিন্ন ভারতবিরোধী পদক্ষেপে প্রমাণিত যে নিজের স্বার্থে আমেরিকা সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর পাকিস্তানকে তোল্লাই দিতে প্রস্তুত এবং প্রয়োজন হলে ভারতকে অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে বা অন্যপথে অনৈতিকভাবে হলেও টাইট দিতে পিছপা নয় আমেরিকা। সঙ্গত কারণেই উন্নতিশীল এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কলকাঠি নাড়তে ও হস্তক্ষেপ করতে সদা তৎপর আমেরিকার ডিপ স্টেট। প্রশ্ন জাগতেই পারে আমেরিকার মদতে চিনপন্থী ওলি সরকারের পতনের ফলে ভারতের কি এমন অসুবিধা হতে পারে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে নেপালের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত খোলা ও কার্যত বাধাহীন আন্তর্জাতিক সীমান্ত। সেকারণে সেদেশে অস্থিরতা দেখা দিলে সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে রাজনীতির লোকেরা ছাড়াও অপরাধী চোরাকারবারী থেকে জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা যে কেউ খুব সহজেই অনুপ্রবেশ করতে পারে এদেশে এবং এখানেও গোলমাল পাকিয়ে তুলতে পারে। পাকিস্তানের আই এস আই চক্র নেপালের মাধ্যমেই জঙ্গিদের ভারতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সাথে দেশের বাকি অংশের যোগাযোগের একমাত্র পথ শিলিগুড়ির কাছে ‘চিকেনস নেক’, যার উপর নজর আছে চিন এবং বাংলাদেশ ছাড়াও আরও কোনও কোনও বৃহৎ শক্তির যারা যেকোনোভাবে যেকোনমূল্যেই হোক ভারতকে ভাঙ্গতে চায়।
বাংলাদেশের মতো নেপালেও জোরপূর্বক সরকার পতনের ক্ষেত্রে জেন-জি দের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা লক্ষ্য করা গেছে যারা বিভিন্ন অভাব অভিযোগ ও প্রশাসনিক শীর্ষ স্তরেও দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগ্রামে ফ্রন্টলাইনে-এ অবশ্যই আপাত দৃশ্যমান। কিন্তু সেই ‘দুর্নীতি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে যেভাবে ব্যাপক লুঠপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা ও বিপুল সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে, পুড়িয়ে মারা হয়েছে পদত্যাগী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকেও, এমনকি সংবাদে প্রকাশ স্কুলের ‘কমিউনিটি কিচেন’ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে প্রশ্ন জাগে স্বাভাবিকভাবেই-এই জেন-জিদের সহিংস বিক্ষোভ কি সত্যই স্বতঃস্ফুর্ত, না কোনও বিশেষ শক্তি তাদের পেছন থেকে সুতো টেনে পরিচালনা করেছে বাংলাদেশের মতো ‘মেটিকুলাস ডিজাইনে’-অল্পবয়স্কদের পরিকল্পিতভাবে উন্মত্ত করে লিপ্ত করা হয়েছে ধ্বংসাত্মক কাজে? হয়ত ভবিষ্যতই এর উত্তর দেবে ।
পরিশেষে, এমতাবস্থায় গোড়ায় উল্লেখিত শ্রী ভাগবত উবাচ চেতাবনি অনুসরণে বলতেই হয় যে ক্ষমতাসীন সরকারেরও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থেকে যায় জনগণের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকার৷