ভারতে কৃষকদের সমস্যা ও সমাধান

ফাইল ছবি।

মোহিত করাতি

ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ভারতীয় অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে কৃষির ভূমিকা অপরিসীম। খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং গ্রামীণ উন্নয়নে কৃষকদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের এই অন্নদাতারাই আজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক অবহেলা ও নীতিগত দুর্বলতা—সব মিলিয়ে কৃষকদের জীবন আজ সংকটাপন্ন। এই প্রবন্ধে ভারতে কৃষকদের প্রধান সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করা হবে এবং সেই সঙ্গে সম্ভাব্য সমাধানগুলিও আলোচনা করা হবে।

১. অর্থনৈতিক সমস্যা
ক) ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া
ভারতের অধিকাংশ কৃষক ছোট ও প্রান্তিক। তারা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে কৃষকরা কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচও ওঠে না।
খ) ঋণের বোঝা
কৃষিকাজে বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ও যন্ত্রপাতির জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় কৃষকরা মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। ফলে ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়তে থাকে।


২. প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত সমস্যা
ক) অনিশ্চিত আবহাওয়া
ভারতীয় কৃষি প্রধানত মৌসুমি বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। অনিয়মিত বৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
খ) জল সংকট
অনেক রাজ্যে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থার অভাবে কৃষকরা সময়মতো চাষ করতে পারেন না।

৩. প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত সমস্যা
ক) আধুনিক প্রযুক্তির অভাব
আজও ভারতের বহু কৃষক আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ। উন্নত বীজ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, ড্রিপ ইরিগেশন বা স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থার সুবিধা তারা পুরোপুরি পান না।
খ) সংরক্ষণ ও পরিবহন সমস্যা
ফসল কাটার পর সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ নেই। ফলে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় রাস্তা ও পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতাও বড় সমস্যা।

৪. সামাজিক ও শিক্ষাগত সমস্যা
ক) শিক্ষার অভাব
বেশিরভাগ কৃষক পর্যাপ্ত শিক্ষিত নন। ফলে তারা সরকারি প্রকল্প, ভর্তুকি বা নতুন কৃষি পদ্ধতির সুযোগ সম্পর্কে জানেন না।
খ) সামাজিক মর্যাদার অভাব
কৃষকদের সমাজে প্রাপ্য সম্মান অনেক ক্ষেত্রে নেই। এর ফলে নতুন প্রজন্ম কৃষিকাজে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং শহরমুখী হচ্ছে।

৫. নীতিগত ও প্রশাসনিক সমস্যা
ক) সরকারি প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া
সরকার নানা কৃষি সহায়তা প্রকল্প চালু করলেও অনেক সময় সেগুলির সুবিধা প্রকৃত কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না। দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতা এর অন্যতম কারণ।
খ) ফসল বিমার সীমাবদ্ধতা
ফসল বিমা থাকলেও ক্ষতিপূরণ পেতে কৃষকদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতির তুলনায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণও খুব কম।

কৃষকদের সমস্যার সমাধান
১. ন্যায্য মূল্য ও বাজার সংস্কার
কৃষকদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে যাতে কৃষক সরাসরি সরকারের কাছে ফসল বিক্রি করতে পারেন। এছাড়া ই-নাম (e-NAM) এর মতো ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থাকে আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন।

২. ঋণ ও আর্থিক সহায়তা
কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। সুদের হার কমানো এবং ঋণ মকুব নয়, বরং আয়ের স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। কৃষক ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা আরও বিস্তৃত করা দরকার।

৩. সেচ ও জল ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন
ড্রিপ ও স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, জলাধার নির্মাণ এবং নদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে জল সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।

৪. আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ
কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্প্রসারণ কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে স্মার্ট কৃষি, জৈব কৃষি এবং জলবায়ু সহনশীল চাষ পদ্ধতি শেখানো উচিত।

৫. সংরক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন
গ্রামীণ এলাকায় কোল্ড স্টোরেজ, গুদামঘর ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে ফসল নষ্ট কম হবে এবং কৃষক অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন।

৬. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি
কৃষকদের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ালে তারা সরকারি প্রকল্প, আবহাওয়ার তথ্য ও বাজারদরের খবর সহজে জানতে পারবেন।

৭. সামাজিক সম্মান ও যুবকদের অংশগ্রহণ
কৃষিকাজকে লাভজনক ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে তুলে ধরতে হবে। যুবকদের কৃষিতে আকৃষ্ট করতে স্টার্টআপ, কৃষি উদ্যোক্তা ও এগ্রি-বিজনেসের সুযোগ তৈরি করা দরকার।

উপসংহার
ভারতের কৃষকরা আজ বহু সমস্যার মুখোমুখি হলেও সঠিক পরিকল্পনা, নীতিগত সংস্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে—এই উপলব্ধি নিয়ে সরকার, সমাজ ও নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। কৃষকদের আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেই ভারত সত্যিকারের উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।