মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বিধানসভা জিইয়ে রেখে অবশেষে মণিপুরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছে। বিজেপির শাসনে মণিপুরে গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে হিংসাত্মক বিশৃঙ্খলা। ওই রাজ্যের স্বার্থে নয়, শাসক জোটের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটানোর জন্য যাতে কিছুটা সময় পাওয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যে সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংই মণিপুরে হিংসার মূল অপরাধী। এই গোটা পর্বে যার পিছনে ছিল বিজেপি-আরএসএস শিবিরের সমর্থন। এখন যেহেতু বীরেন সিংয়ের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা আদালত খতিয়ে দেখছে এবং আদালতে তাঁর এই ভূমিকার প্রমাণও পেশ করা হয়েছে, তাই তিনি ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, তাঁর সামনে ইস্তফা দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না।

মণিপুরের সাধারণ মানুষের জীবনে যে গভীর সংকট নেমে এসেছে, তার সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করেছে শাসক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়েই। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও এমন সমস্যাদীর্ণ রাজ্যটিতে যেতে অস্বীকার করেছেন। এর মধ্যে দিয়ে শাসক দল ও তাদের পরিচালিত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। বিজেপির কাছে রাজ্য ও তার জনগণের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ।

রাষ্ট্রপতির শাসন কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। মণিপুর নিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না কেন্দ্রীয় সরকার। ওই রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজনের যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে অবিলম্বে তা মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকেই। সমস্ত রাজনৈতিক দলকেও যুক্ত করতে হবে এই প্রক্রিয়ায়, যাতে ন্যায়সঙ্গত সমাধানে পৌঁছনো যায়। মণিপুরে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি।


২০১৪ সালে দিল্লিতে মোদির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়োর পর থেকেই, সব রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির স্লোগান ছিল ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’। কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারেই বিজেপি থাকলে নাকি রাজ্যের উন্নয়ন হবে দারুণ এবং আসবে সুস্থিতি ও সুশাসন। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মণিপুরে ক্ষমতায় আসে বিজেপি, যদিও নির্বাচনে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিজেপি ওই নির্বাচনে ৬০টি আসনের মধ্যে ২১টি আসন পেয়েছিল। বিজেপি এরপর অন্যান্য ছোট দল এবং নির্দল প্রার্থীদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। ২০২২ সালের নির্বাচনে, বিজেপি মণিপুর বিধানসভায় ৬০টি আসনের মধ্যে ৩২টি আসনে জয়লাভ করে এবং রাজ্যে সরকার গড়ে। এরপর থেকেই মণিপুর হয়ে ওঠে জাতিদাঙ্গায় অগ্নিগর্ভ। কুকি বনাম মেইতেই, এই দুই জনগোষ্ঠীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এই দাঙ্গায় মদত দেন। সরকারি হিসেব অনুযায়ী প্রায় তিন শতাধিক মানুষ এই জাতিদাঙ্গায় প্রাণ হারান।

২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই ও কুকি বিরোধ ভয়াবহ দাঙ্গায় পরিণত হয়। এই সংঘর্ষের মূলকারণ ছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন নানা টানাপোড়েন, যাকে ব্যবহার করে আরএসএস ও বিজেপি। মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের জন্য বিশেষ আর্থিক সুবিধা এবং চাকরি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল, যার ফলে কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। কুকিদের জমির অধিকার রক্ষার প্রশ্নটি এর ফলে ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কারণ কুকি অধ্যুষিত এলাকায় মেইতেই ও অন্যান্যদের জমি কেনার অধিকার নেই। মেইতেইদের অধিকাংশের বাস শহরাঞ্চলে, আর কুকিরা সাধারণত পাহাড়ে বাস করে। বীরেন সিংয়ের সরকার সরাসরি মেইতেইদের ইন্ধন দিতে থাকে, ফলে কুকিদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক তৈরি হয় এবং তা ক্রমশ জাতিগত সংঘর্ষের দিকে চলে যায়। বারবার দাবি ওঠা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মোদী একবারের জন্যেও সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও বিজেপি সরকার গড়ে নেবে। কয়েক বছর ধরে একথাটা বহুল প্রচলিত। কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে ম্যাজিক সংখ্যা থেকে অনেক পেছনে থেকেও সরকার গঠন করেছে বিজেপি। এর কৃতিত্ব সবটাই অমিত শাহকে দিয়েছে দল। জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে ঘোড়া কেনাবেচার মাধ্যমে অন্যায়ভাবে সরকার গঠনে পারদর্শী অমিত শাহকে অবশ্য গোদি মিডিয়া ‘চাণক্য’ তকমা সেঁটে মহান বানানোর চেষ্টা করে।

এবার বিধানসভাকে সাংবিধানিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হলো। অবশ্য মণিপুরে বীরেনের উত্তরসূরি বাছাই না করতে পারা নিয়ে চাণক্যের ব্যর্থতা নিয়ে গোদি মিডিয়া চুপ।