দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের অনুপ্রেরণা স্বামী বিবেকানন্দ

ফাইল চিত্র

ড. বিমলকুমার শীট

স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান (১৮৮৮-১৯৭৫) দু জনই ভারতবসীর কাছে বেশ পরিচিত নাম। প্রথম জন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক ও লেখক। দ্বিতীয় জন হলেন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন (১২ জানুয়ারি)-কে জাতীয় যুবদিবস হিসাবে পালন করা হয় আর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন ভারতে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ১৯৬২ সালে রাধাকৃষ্ণানের কাছে ছাত্ররা তাঁর জন্মদিনটি পালন করতে চাইলে তিনি উত্তরে বলেন, ‘তোমরা যদি ওই ৫ সেপ্টেম্বর তারিখটাকে আমার জন্মদিন হিসাবে পালন না করে, একে শিক্ষক-দিবস হিসাবে উদযাপন কর তবে আমি গর্ববোধ করব’। এর আগে শিক্ষকতার ন্যায় মহান পেশায় নিযুক্ত শিক্ষকদের জন্য কোনো দিবস পালন করা হত না। সেই বছরই প্রথম ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের সারস্বত চর্চা ও দর্শন ভাবনা স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছিল।

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ভেলোরের ভুর্হিস কলেজ ও মাদ্রাজে খ্রিস্টান কলেজে অধ্যয়ন করে ১৯০৯ সালে দর্শনে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কোনো কোনো খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে বেদান্ত দর্শনে নীতিবোধের কোনো স্থান নেই। রাধাকৃষ্ণান এমএ পরীক্ষায় যে গবেষণা নিবন্ধ পেশ করেন, তার বিষয় ছিল বেদান্তে নীতিশাস্ত্রের ভূমিকা। এটি ছিল খ্রিস্টান মিশনারিদের ধারণার ওপর মুখের মতো জবাব। রাধাকৃষ্ণানের অধ্যাপক এ জি হগ তাঁর গবেষণা নিবন্ধ পড়ে এতখানি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে এমএ পরীক্ষায় ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ করেন। অল্প সময়ের মধ্যে রাধাকৃষ্ণানের অধ্যাপনার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালে তিনি মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে অধ্যাপনা করেন। তারপর অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৩১-৩৬) ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ (১৯৩৯-৪৮) অলঙ্কৃত করেন। দেশে বিদেশে নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে দর্শনের ওপর বক্তৃতা দিয়েছেন এবং সেখান থেকে নানা উপাধি পেয়েছেন। ব্রিটিশ সরকারও রাধাকৃষ্ণানকে ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন ।
১৯০৬-১৯১২ এই পর্বে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জীবনে সারস্বত চর্চা ও দর্শন ভাবনার ক্ষেত্রে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। এই দুটি ঘটনা তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। প্রথমটি ছিল স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত লাভ এবং এরপর তাঁর মনে এক উথালপাথাল অনুভূতির সঞ্চার হলো। যে দোলাচল তাঁকে পীড়িত করেছিল সেই বালক বয়স থেকে তা যেন এক লহমায় দূর হলো।


স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মনে রেখো পাশ্চাত্যকে দেওয়ার অনেক কিছু আছে তোমাদের’— এ কথা রাধাকৃষ্ণানকে উজ্জীবিত করেছিল। বিবেকানন্দের দেশপ্রেম, বিবেকানন্দের সাহস, তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী রাধাকৃষ্ণান আত্তীকরণ করে ফেললেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে (১৮৯৩) বিভিন্ন ধর্মের প্রথম সারির বক্তাদের যেভাবে বিবেকানন্দ অতি সহজে পরাজিত করে ভারতবর্ষের গৌরব তুলে ধরেছিলেন তাতে রীতিমতো রোমাঞ্চিত বোধ করলেন তিনি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে অকুণ্ঠচিত্তে রাধাকৃষ্ণান সেদিনের মনোভাবের কথা লিখেছেন, ‘বিবেকানন্দের রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত না হলে আমার জীবনটা একেবারে অন্যরকম হয়ে যেত।’

বিবেকানন্দের বলা ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্যবরাণ নিবোধত’ কঠোপনিষদের এই কথা তাঁকে ভারতবাসী বলে গর্ববোধ করতে শেখাল। বিবেকানন্দ সংস্কৃতে প্রখর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি না থাকলে ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে সম্যক ধারণা হয় না। রাধাকৃষ্ণান সংস্কৃত ও হিন্দি খুব যত্ন করে অধ্যয়ন করেছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে বিবেকানন্দের মূল ভাবনাকে আত্মস্থ করা সহজ হয়েছিল। সারাটা জীবন রাধাকৃষ্ণান বিবেকানন্দকে অনুসরণ করে এগিয়ে গিয়েছেন।
১৯৬৩ সালে ২০ জানুয়ারি কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের শতাব্দী জয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধন করতে গিয়ে রাধাকৃষ্ণান বলেছিলেন ‘যখন আমি ম্যাট্রিকুলেশন ক্লাস অথবা তার কাছাকাছি কোনো ক্লাসের ছাত্র ছিলাম, তখন আমরা অদম্য উৎসাহে স্বামীজির পত্রাবলী বহু সংখ্যায় নকল করে ছাত্র সমাজের মধ্যে বিতরণ করতাম। স্বামীজির রচনাবলী পড়ে যে রোমাঞ্চ অনুভব করেছি, যে আশার আলোক দেখেছি, যে আত্মপ্রত্যয়ের সন্ধান পেয়েছি, তা তুলনাহীন। স্বামীজির রচনাবলীর মধ্যে এক অসামান্য সম্মোহনী শক্তি ছিল, যা তরুণ চিত্তকে অতি সহজে আকৃষ্ট করত। তাঁর রচনাবলী পড়ে আমরা তরুণ বয়সেই উপলব্ধি করেছি যে, তিনি যে ধর্মের কথা বলতেন সেটা মানুষ গড়ার ধর্ম। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন যে, ধ্যানের জগৎ আর সমাজসেবার জগৎ— এ দুটি পরস্পর বিরুদ্ধ নয়, একই সত্যের এপিঠ আর ওপিঠ। স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই অপরিমেয় আধ্যাত্মিক শক্তি আছে। সেই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে মানুষ ধীরে ধীরে নিজেকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। এই পরিপূর্ণতা অবাধ অর্থসঞ্চয়ের মধ্যে নেই, নেই খ্যাতি আর প্রতিপত্তির মধ্যে। এই পরিপূর্ণতা রয়েছে মানুষের হৃদয়কন্দরে, যেখানে অসীমের স্পর্শ মানুষকে নিরন্তর এমন প্রেরণা দেয়, যাতে সে বহু মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে পারে, জীবকে শিবরূপে উপসনা করতে পারে’।

স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীশ্রীগীতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, গীতার মূল শিক্ষা তিনটি— আত্মশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও নিষ্কাম কর্ম। রাধাকৃষ্ণান একে জীবনের সংকল্প বাক্য রূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাই দেখা গেছে যখনই যেখান থেকে নতুনতর দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান এসেছে, তিনি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যাচাই করে নিয়েছেন এতে তাঁর মূল সারস্বত লক্ষের বিচ্যুতি ঘটবে কিনা। স্বামী বিবেকানন্দকে অনুসরণ করেই তিনি হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থগুলি মূল সংস্কৃতে পড়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণান নিজেই লিখেছেন যে, উপনিষদ, গীতা, ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতি সবই তিনি পড়েছিলেন। এঁদের উপর শঙ্করাচার্য, রামানুজ, মধ্ব, নিম্বার্ক প্রমুখ প্রধান আচার্যদের ভাষ্যগুলিও মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করেন। এর খুব প্রয়োজন ছিল। কারণ, এই সব আচার্যদের মত অবলম্বন করেই বেদান্ত দর্শন গড়ে উঠেছে। পোলে, ম্যাক্সম্যুলার প্রমুখ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মাধ্যমে উপনিষদ বহির্বিশ্বে প্রচার ও আদৃতি লাভ করে। সে কারণে উপনিষদ বা বেদান্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ধর্মবিজ্ঞান-চর্চার সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। এটি স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বুঝেছিলেন, তেমনই বুঝেছিলেন রাধাকৃষ্ণান।

তবে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান শ্রীঅরবিন্দের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। ঈশ্বর এবং ব্রহ্ম সম্পর্কে দার্শনিকদের চুলচেরা মতপার্থক্য রয়েছে। রাধাকৃষ্ণান সেই সমস্যার সমাধানকল্পে বলেছেন যে, ঈশ্বর এবং ব্রহ্ম উভয়েই চিৎশক্তি। ব্রহ্ম দেশকাল রহিত, অব্যয়। ঈশ্বর সেই ব্রহ্মেরই একটি প্রকাশ বা একটি ভঙ্গিমাত্র। এই সিদ্ধান্তে আসার মূলে স্বামী বিবেকানন্দ যেমন, তেমনই শ্রীঅরবিন্দও তাঁকে প্রভাবিত করেছেন। শ্রীঅরবিন্দের প্রতি তিনি প্রকাশ্যে ঋণ স্বীকার না করলেও তাঁর অজস্র রচনাবলীর মধ্যে শ্রীঅরবিন্দের প্রভাব সুস্পষ্ট।