ইস্যু অনুপ্রবেশ

প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির সব নেতা-মন্ত্রীরা অনর্গল বলে চলেছেন বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা এসে এদেশের জনসংখ্যার মানচিত্রটাই বদলে দিচ্ছেন। ভোটের ময়দানে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম প্রধান অ্যাজেন্ডা বিদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। ভারতের প্রতিবেশী দেশ ৬৩টি। মোদী সরকার ও শাসক দল বিজেপির ভাষ্য অনুযায়ী অন্য কোনও দেশ থেকে অনুপ্রবেশ ঘটছে না। কেবলমাত্র বাংলাদেশ থেকেই অনুপ্রবেশ ঘটছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কতজন বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকেছে তার কোনও তথ্য-পরিসংখ্যান কেন্দ্র বা রাজ্য প্রকাশ করেনি। তাই অনুপ্রবেশকারীতে দেশ ভরে যাচ্ছে এমন ভাষণ প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

সাধারণভাবে অনুপ্রবেশ হয় গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে কাজের অভাবে, রুজির টানে অনেকে বিদেশে পাড়ি দেয় ঝুঁকি নিয়ে বেআইনিভাবে। এমনই কাজের সন্ধানে মানুষ যায় আমেরিকা সহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশে। এদের মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বিপুল। আর অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য আমেরিকায় ভারতীয় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে সর্বাধিক হলো মোদী-শাহর রাজ্য গুজরাতের। মোদীর মডেল রাজ্য গুজরাত নাকি দেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত। অথচ সেই গুজরাতের মানুষ সর্বাধিক সংখ্যায় রুজির আশায় আমেরিকায় যাচ্ছে বেআইনিভাবে। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন যেসব বিদেশিদের ফেরত পাঠিয়েছে, তাদের মধ্যে ভারতীয় অনেক। আর তাদের বেশির ভাগ গুজরাতের।

ভারতীয়রা যে কারণে বিদেশে অবৈধভাবে যায় বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ এসে থাকে, সে কারণেই এসেছে। মার্কিন সরকারের কাছে বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তথ্য পরিসংখ্যান আছে। মোদী সরকারের কাছে তেমন কোনও তথ্য নেই। থাকলেও তা প্রকাশ করে না গুজব ফাঁস হয়ে যাবে বলে। আসলে মোদী প্রশাসন বাংলাদেশিদের টার্গেট করেছে তারা মুসলিম বলে। নেপাল, ভুটান, মায়ানমার থেকে এলে তারা যেহেতু মুসলিম নয় তাই ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি জমবে না। বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলে আসলে বাংলাভাষি মুসলিমদেরই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।


গত কয়েক মাস ধরে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষি মুসলিমদের যেভাবে ধরপাকড় করে হেনস্তা করা হচ্ছে, সেটা পরিকল্পিত। দেশজুড়ে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে যে, বাংলাদেশি মুসলিমরা এসে জমি, চাকরি দখল করছে। আদিবাসী, হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে প্রচুর সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে তারাই দেশটার দখল নেবে। অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো হলেও বিজেপি এটাকেই বিশ্বাস করাতে চাইছে ভোটের স্বার্থে মেরুকরণের জন্য। ভারতে ১৪৫ কোটি মানুষের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ২৩ কোটির কাছাকাছি। বাংলাদেশে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ১৭ কোটি। বাংলাদেশের সব মুসলিম ভারতে চলে এলে ৪০ কোটি হবে। কাজেই অনুপ্রবেশের রাজনৈতিক জিগির তোলা এক ধরনের পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

ভারতে সম্প্রতি বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিমদের একাংশের উপর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি ও বৈষম্যের অভিযোগ উঠছে। গোরক্ষা, লাভ-জিহাদ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন ইত্যাদির যুক্তি বা অজুহাতে টার্গেট করা হচ্ছে মুসলিমদের। কোনও কোনও ঘটনায় মুসলিমদের বাড়িঘর ভাঙা, গণপিটুনি, ভয়ভীতি ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ঘটনাও সামনে এসেছে। শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসাতেও মুসলিম সম্প্রদায় নানা প্রতিবন্ধকরতার মুখে পড়ছে। সমালোচকদের মতে, এসব কার্যকলাপ সমাজে বিভাজন বাড়িয়ে তুলছে এবং সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে দুর্বল করছে। ভারতের সংবিধান ধর্মকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে যে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার নিয়ে নিজ নিজ পছন্দের ধর্ম মানতে, পালন করতে ও প্রচার করতে পারেন। এবং রাষ্ট্র কোনও ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা না দিয়ে সব ধর্মকে সমানভাবে দেখে।

পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই বহুত্ববাদী ও সহনশীলতার মাটি। এখানে প্রায় দেড় কোটি অবাঙালি মানুষ স্থায়ী বসবাস করে সমাজের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। পশ্চিমবঙ্গ বহু সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাঙালি মুসলিম ও বাংলাভাষা দিয়ে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায় না বাংলাদেশিদের। এ রাজ্যের প্রকৃত নাগরিকও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে। নাগরিকত্বের যথেষ্ট প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও ভিনরাজ্যে বাঙালি নির্যাতন বেড়েই চলেছে। অন্য রাষ্ট্রের (বিশেষ করে বাংলাদেশ) নাগরিক হলেও তাঁকে নির্যাতন করা যায় না, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। ‘পুশব্যাক’-এর নামে পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত নাগরিককেই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিএসএফ কেন্দ্রের নির্দেশে।

এসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে ও সমাজ মাধ্যমে। হিন্দুত্ববাদীদের তুষ্ট রাখতে বেআইনি কার্যকলাপ বন্ধের জন্য বেআইনি পদক্ষেপ কখনওই প্রকৃত সমাধান নয়। প্রকৃত সমাধানের রাস্তা হল আধার কার্ড, সচিত্র ভোটার কার্ড, জন্মপঞ্জি, নাগরিকত্বের প্রমাণ ইত্যাদি। ‘অনুপ্রবেশ’ শব্দটি এখন বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের কাছে ‘তুরুপের তাস’ হয়ে উঠেছে।