২৭ জুন রাহুল দেব বর্মণের ৮৩ তম জন্মবার্ষিকীতে দৈনিক স্টেটসম্যানের বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য জাগো শোনেয়ালো, শুনো মেরি কহানি গানের সুরে এভাবেই ঘুম ভাঙালেন পঞ্চম

জাগ্যে শোনেওয়ালা, শুনো মেরি কানি-১৯৬৫ সাল মাত্র ২৫ বছর বয়সে নায়ক মেহমুদের গলায় কিশোর কুমারকে নিয়ে এই গানটি গাইয়ে আপামর ভারতবাসীকে সোচ্চারে জানিয়ে দিলেন পঞ্চমদা তিনি এসে গিয়েছেন।

আগামী ২০-৩০ বছর তিনি লাইট মিউজিকের দুনিয়ায় রাজত্ব করবেন। বিখ্যাত গায়ক ও সুরকার শচীনদেব বর্মণের একমাত্র পুত্র রায়ল জন্মেছিলেন সুরের জগতে রাজার মতই বিচরণ করতে। পড়াশুনোয় মন ছিল না। বন্ধু জুটিয়ে ছাত্রাবস্থাতেই নানা সুর তৈরি করতেন রাহুল।

১৯৪৬ সালে সিনেমা হলে ‘ফাল্গুস’ সিনেমাটি দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন অ্যায় মেরে টোপি প্লট কে অ গানটি তার নিজেই তৈরি করা সেই সুর পিতা ব্যবহার করেছেন। তখন রাহুল দেব বর্মণের বয়স পনেরো-নোলো।


এরপরেই পড়াক্তরর পাট চুকিয়ে পিতার সহকারি হতে মুম্বই চলে গেলেন। পিতা নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বড় হয়ে কি হতে চাও?

সদর্পে পুত্র বলেছিল, ‘তোমার চেয়েও বড় সুরকার। পিতাকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছিলেন কিনা সেটি বিতর্কের বিষয় তবে কিশোর ব্যাসেই রাহুলের আনুবিশ্বাস ছিল প্রশংসনীয়।

পরিবর্তে ‘পঞ্চম‘ নামটি পেয়েছিলেন বম্বেতে পিতার কাছে গিয়ে তাকে নামটি দিয়েছিলেন অশোক কুমার। পাঁচ বছর পিতার সহকারি থাকার পর মেহমুদ সাহেল ১৯৮১ তে ছোটে নবাব সিনেমায় প্রথম সুযোগ দিলেন রাহুলকে। পরবর্তী সুযোগ ভূত বাংলো’৷

১৯৬৪ তেতিনটি অসামান্য সুত্র দিলেও চূড়ান্ত সাফল্য পেলেন পরের বছর তিসরি মঞ্জিল ও হাসিনা’ ‘আজ আগা’, ‘ও মেরি সোনা রে-সুরের যাদুতে ভারতবাসী উন্মাদ হয়ে গেল। প্রযোজক নাসির সেনের সঙ্গে পরবর্তী কুড়ি বছরে পরপর যুগান্তকারী সব কাজ করলেন।

বাহারও কে স্বপনে, পারে বা মৌসম, ক্যারাভ্যান, ইভানো কি বারাত’ , ‘হাম কিসিসে কান নেহি ইত্যাদিতে সুরের ঝুলি পূর্ণ হয়ে উঠল রাহুল দেব বর্মনের।

পিতার সহকারি হিসেবে সত্তর সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। দেন আনন্দ ‘হারে রাম হারে কৃষ্ণা’-র পরে পরপর কাজ নিলেন ।

দুই বাঙালি শক্তি সমস্ত এবং ঋষিবেশ মুখার্জি বারবার অসাধারণ কাজ করালেন। ‘কটিপতঙ্গ’, ‘অমর প্রেম’, ‘আজনবী’, ‘দ্য গ্রেট গামলার’, অনুসন্ধান, ‘অন্যায় অবিচার’,’অলগ অলগ’ বুডা গোয়া’, ‘নমকহারাম’, ‘গোলমাল’, জুমানা, ‘বেমিশাল’, ‘যুবসুরত’ ইত্যাদি সিনেমার নামগুলি যথেষ্ট। যশ চোপড়া, মনমোহন দেশাইরা দুটি করে সুরেলা সিনেমা করালেও সিল্লি ব্যানার পরপর সিনেমা করিয়ে গেলেন।

‘শোলে’, ‘শান’, সাগর, ‘সাতে পে সাত্তা,’জবা ( রমেশ সিপ্পি ও রাজ সিল্লি) প্রতিটি সিনেমার সাসফল। তার পরপর সফল সিনেমা করেছেন রাহুল দেব বর্মণকে নিয়ে। ‘পরিচয়’, ‘আধি’, ‘খুশবু’, কিনারা, ‘ইজাজত’, ‘কিতাব’, ‘লিবক্ত’।

রমেশ বহেল করালেন ‘কসমে ওয়ানো, ‘হারজায়ি’, ‘পুকার’ জাওয়ানি’ এছাড়াও অন্যান্য বহু পরিচালক মিলিয়ে মোট ২৯২ টি হিন্দি সিনেমায় সুর দেব বর্মণ যাত্রা শুরু করলেন আশা ভোঁসলে মার কিশোর কুমারকে দিয়ে। যাব কি যাব না ‘ , ‘ যেতে দাও আ ডেকো না ‘ এবং ‘ সে তো এল না। বাঙালি শ্রোতা চমকে উঠল। পরবর্তী ১৫ বছর একের পর এক অসামান্য। ‘

সভাবেলায় তুমি আমি নায় স্কুলে গড় নেই ‘ ‘ ময়না বল তুমি ‘ , ‘ বধুয়া রিমিঝিমি ‘ , মনে পড়ে কবি রায় ‘ , ‘ সজনী গো , ‘ বা কি আছে গো ‘ , ‘ লক্ষীটি দোহাই ‘ ‘ ফিরে এলাম অনুরাধা ‘ , ‘ বাঁশি শুনে কি ‘ , ‘ আসর আরেক দিন লম্বা এক তালিকা।

১৯৬৯ সালে পিতা ও পুত্র উভয়ের কণ্ঠে পুজোসংখ্যায় গান বের হল। পিতার সঙ্গে ‘ বর্ণে গন্ধে ছন্দে ‘ , যে সুরটি শচীনদের প্রেম পূজারী ‘ তে ব্যবহার করলেন।

পুত্র গাইলেন মনে পড়ে রুবি রায় ‘ মেরি ভিনগ্র ডিগ্রি ‘ হল যার হিন্দি রূপ। ১৯৭০ সালে প ডুয়েট গান হল ‘ জানি না কোথায় তুমি ‘।

যে সুরটি রণধীর কাপুর জয়া ভানুড়ির সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী কুড়ি বছর ধরে নিয়মিত পুজো সংখ্যার জন্য বিখ্যাত গান উপহার দিয়ে সেজেন রাজাদের।

‘ রাজকুমারী ‘ ‘ কলম্বিনী কম্বাবতী ‘ ‘ জয়ী ‘ , ‘ তিন মূর্তি ‘ থেকে ‘ শ্বেত পাথরের মালা ‘ পর্যন্ত ৩১ টি বাংলা সিনেমায় সুর করেছেন। করেছেন তামিল তেলেও ইত্যাদি ভাষার আটটি সিনেমা। সাতটি আন্তর্জাতিক আলবামও করেছিলেন।

হেমন্ত কুমার , সলিল চৌধুরী , শচিনদেব বর্মনসহ বহু সুরকার বাংলা ও হিন্দি সিনেমা সুখ দিয়েছিলেন। বম্বেতে ছিলেন মদনমোহন , শঙ্কর কিশান , নৌশাদ , হৈম , লক্ষীকান্ত পেয়ারেলাল বাপ্পি লাহিড়ীও।

তাহলে রাহুলদের বর্মণ এদের থেকে বেন স্পেশাল ! কেন তিনি য আসলে তিনি বঙ্গে সুরের জগত আমূল বদলে দিয়েছিলেন তিনি ।

হিন্দি সিনেমায় সফলভাবে ওয়েস্টার্ন মিউজিক এনেছিলেন । দম মারো দম ” , ” পিয়া তু , আর তো আজা , ‘ মেহেবুবা মেহবুবা জাতীয় সুর আগে কেউ কখনও শোনেনি।

কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি সুরের অনুপ্রেরণা থাকলেও তা সরাসরি নকল নয়। রাগাশ্রয়ী গানের সুরেও তিনি ছিলেন চ্যাম্পিয়ন।

দ্বিতীয়ত রফি সাহেব বা লতাজিকে দিয়ে মান সাওয়ালেও কিশোর কুমার ও আশাজিকে তিনি প্রতিষ্ঠার ভিন্ন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।

অভিজিৎ, উদিত, পূর্ণিমা সহ বহু উঠতি গায়ককে সুযোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সাবিনা ইয়াসমিন, এ্যান্ড্রু কিশেনকে দিয়েও গাইয়েছেন।

বম্বের বহু নায়কপুত্র (সানি দেওল, সঞ্জয় দত্ত কুমার গৌরব, রণধীর কাপুর ইত্যাদি) রাহুলদের বর্মনের সুরের হাত ধরেই প্রথম খ্যাতিলাভ করেছিলেন।

হুজুকে পড়ে রীতা প্যাটেলকে বিয়ে করে সুখী ফানি রাহুল দেব বর্মন। গানের জগতে অতি ব্যস্ততম থাকায় স্ত্রীকে সময়ও দিতে পারতেন না।

১৯৭১ সালে ডিভোর্স হয়ে গেল। আশাজি প্রেম নিবেদন করলেন। দুটি সম্পর্ক নিয়েই পিতা শচীন ও মাতা মীরা অসম্ভব অসন্তুষ্ট ছিলেন।

১৯৭৫ সালে পিতার মৃত্যুর অনেক পরে আশকে নিয়ে করেন। মা মীরা দেবী সেই সময় থেকেই মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

সূরের মাধ্যমে প্রেমের বন্ধনে জড়ালেও আশাজিকে নিয়ে প্রকৃত সংসার করা হয়নি পঞ্চমের। বয়সে পাঁচ বছরের বড় আশার পূর্বের বিয়ের তিন সন্তান ছিল। তিনি তাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।

আশির দশকের শেষ দিকে পঞ্চমের মাটি ডাউন হতে আশা মানসিকভাবে পাশে রইলেন না তেমন করে। শেষদিকে পুজো সংখ্যার গান উষা উথুপ ইন্দ্রানী সেনাদের দিয়ে খাইয়েছেন।

সুভাস ঘাই রাম লক্ষণ এর সুর দেওয়ার জন্য পঞ্চমকে রাজি করিয়েও পরে সুরকার বদলে দিলেন। প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হল এই সময়। বিধুবিনোদ চোপড়া পরিষ্কার পরে নিলেন বিগ বাজেটের ১৯৪২ লাভ স্টোরি ‘।

আশাজির প্রতি অভিমানেই হয়তো তাঁকে দিয়ে একটাও গান গাওয়ালেন না। লতাজি আর কবিতা কৃষ্ণমূর্তি গাইলেন। গান বিখ্যাত হল। তবে চূড়ান্ত সাফল্য দেখে যেতে পারলেন না।

সিনেমা রিলিজের আগেই ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি আচমকাই আপামর ভারতবাসীকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে।

পড়ে বইল ভক্তদের জন্য গানের ডালি, আমাদের ফিরে ফিরে শোনাবার জন্য। বারবার, বহুবার নতুন নতুন করে তাঁকে আবিষ্কারের জন্য।