বেতনবৈষম্য নয়, অষ্টম বেতন আয়োগ কর্মসংস্থান বাড়াক

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

রানা ঘোষদস্তিদার

রাজ্যটা মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা পশ্চিমবঙ্গ যাই হোক না, সাধারণ স্তরের এক সরকারী চাকরির কয়েকশো পদে নিয়োগের পরীক্ষা দিতে কয়েক লক্ষ উচ্চশিক্ষিত যুবক- যুবতী আবেদন করেছেন, সাসারাম রেলস্টেশনের মত জায়গায় ভিড় করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, পরীক্ষার আগের রাত জেগে ট্রেন, বাসে সফর করে দূর দূরান্ত থেকে পরীক্ষা দিতে আসছেন, এমন ছবি কি আমাদের গা সওয়া হয়ে যায়নি? বা, সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের রায়ে পুনর্নিযুক্ত চাকরি হারানো প্রাথমিক শিক্ষকদের যে আবেগময় উচ্ছ্বাস দেখা গেল, তাতেও যেমন অবাক হবার কিছু নেই, তেমনি রূঢ় বাস্তব হাজারো আরো চাকরিপ্রার্থীর ধর্ণা-বিক্ষোভ। একটি সরকারী চাকরি এই মুহুর্তে ভারতের সাধারণ জনগণের কাছে, বিশেষত কৃষি-ব্যবসা- উদ্যোগ যেখানের সমাজে তত গ্রহণীয় নয়, সেখানে লটারির চেয়ে কিছু কম নয়।

এক কারণ হল এই যে, করোনাতঙ্কের লকডাউনের সময় একেবারে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, যে, ভারতে সরকারী চাকরির মত নিশ্চিত বা সুরক্ষিত চাকরি আর নেই। যেজন্য, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি পেলে বেশি বেতনের বেসরকারী চাকরি ছেড়ে দেবার ঘটনা শোনা যায়। যদিও, বড় কারণ হল একদম উপরতলার কিছু চাকরিকে বাদ দিলে, বেসরকারী ক্ষেত্রের তুলনায় সরকারী চাকরির বেতন সাধারণ ভাবে বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক গুণ বেশি। পরের পর বেতন আয়োগে নিয়ম করে বেতন বেড়েছে সরকারী কর্মচারীদের। তাছাড়া, কয়েক মাস অন্তর মহার্ঘ ভাতা বাড়ানো তো আছেই। পক্ষান্তরে, এক সময়ের আইটি বুমকে বাদ দিলে বাজার অর্থনীতির যা দস্তুর, বেসরকারী ক্ষেত্রের বেতন নির্ভর করেছে পুরোপুরি বাজারের উপর এবং, বাজারে মন্দা মানেই চাকরিতে কোপ, বেতন হ্রাস বা সামান্য মাপের বেতনবৃদ্ধি। সরকারী বেতন বৃদ্ধি পে কমিশন, মানে মূলত সরকারী কর্মচারীরাই ঠিক করে। অর্থনীতির অবস্থা বা এক কথায় বাজারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। তুলনায় বেসরকারী ক্ষেত্রের বেতন স্থির করে বাজার, যেজন্য বাজারের ওঠাপড়ার সাথে বেতনের সরাসরি সম্পর্ক থাকে। এই ব্যাপারটিই পার্থক্য গড়ে দেয়।


ফলে, ভারতের কর্মক্ষেত্র এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে শিক্ষিত যুবসংখ্যার এক বিশাল সংখ্যা যৌবনের এক বিরাট সময় ব্যয় করে ফেলছে সরকারি চাকরির প্রস্তুতিতে, আর ডোমের চাকরি জুটলেও পিএইচডি প্রাপক তাতে যোগ দিয়ে শিক্ষার অপব্যয় করছে। অন্যদিকে, সংগঠিত ক্ষেত্র কুশলী যুবকদের অভাবে মার খাচ্ছে।

সামগ্রিক ভাবে আবার, সংগঠিত ক্ষেত্রে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের অভাবে সাময়িক কর্মী বা গিগ ওয়ার্কার হয়েই স্বল্প বেতনে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে আম ভারতীয়কে। এই অবস্থা পাল্টাতে পারে যদি সরকারী কর্মসংস্থান বাড়ে।
জনসংখ্যার বিচারে ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের সরকারী কর্মচারীদের সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এক পঞ্চমাংশ মাত্র। ২০১১-র সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি লক্ষ ভারতীয়র জন্য পাব্লিক সার্ভেন্টের সংখ্যা ছিল ষোলশো তেইশ। তুলনায় মার্কিনী সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার সাতশো। একত্রিশ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীকে ধরলে, প্রতি লক্ষ ভারতীয় পিছু, কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা ছিল দুশো সাতান্ন। আমেরিকার ফেডারাল গভর্নমেন্টের ক্ষেত্রে, এই সংখ্যাটা ছিল আটশো চল্লিশ!

বর্তমানে ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকার মিলিয়ে পাব্লিক সার্ভিসে কর্মরত প্রায় দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ কর্মচারী। কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা সেনাবিভাগকে ধরে প্রায় পঁয়তাল্লিশ লক্ষ। বাকি এক কোটি পঁচাশি লক্ষ কর্মচারী বিভিন্ন রাজ্য সরকার, পাব্লিক সেক্টর আণ্ডারটেকিং যথা ব্যাঙ্ক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী, রেলওয়ে ইত্যাদিতে কর্মরত। অতএব, প্রতি সহস্র জন প্রতি ভারতের পাব্লিক সার্ভেন্টের সংখ্যা হল ষোল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হল প্রায় সাতাত্তর।

যে দেশের পাব্লিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কার্যকারিতার জন্য বিখ্যাত, বিশেষ করে যার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস গোটা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্তমূলক, সেই ইউনাইটেড কিংডমে পাব্লিক সার্ভিসে কর্মরত ব্রিটিশের সংখ্যা হল আটাত্তর লক্ষ, দেশের মোট তিন কোটি ত্রিশ লক্ষ কর্মীসংখ্যার প্রায় সাড়ে তেইশ শতাংশ। ছয় কোটি সত্তর লক্ষ জনসংখ্যার বিচারে, প্রতি হাজার জনসংখ্যা পিছু, সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা হল একশো ষোলর কিছু বেশি! জার্মানির ক্ষেত্রে সরকারী কর্মচারীর সংখ্যাটা হল প্রতি হাজার জার্মান পিছু সাতাত্তর, জার্মানির মোট কর্মীসংখ্যার প্রায় তেরো শতাংশ। জাপান, তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে, প্রতি হাজার জাপানীর জনসেবায় প্রায় বিয়াল্লিশ জন সরকারী কর্মচারী নিয়োজিত। প্রতি হাজার জনসংখ্যা পিছু, সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা নরওয়েতে একশো ঊনষাট, ব্রাজিলে একশো এগারো, ইউএসএ তে সাতাত্তর, চীনে সাতান্ন, ভারতে মাত্র ষোল! উল্লেখ্য, শুধু সংখ্যাই সব নয়। উৎকর্ষ, কর্মকুশলতা এবং, সততার প্রশ্নও আসে বই কি।

ভারতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কর্মীসংখ্যা খুব কম। ভারতে প্রতি লক্ষ নাগরিক পিছু ডাক্তার আছে সত্তরজন। ইউএসএ তে আছে দুশো ষাট জন, জার্মানিতে চারশো দশ। ভারতের সরকারী স্কুলে পঁয়ত্রিশজন ছাত্র পিছু মাত্র একজন শিক্ষক আছেন। মার্কিন মুলুকে একজন শিক্ষক পিছু ছাত্র মাত্র ষোল, ইউকেতে আঠারোজন। প্রতি সহস্র ভারতীয় পিছু পুলিশ অফিসার আছেন মাত্র দেড় জনের মত। মার্কিন মুলুক বা জার্মানিতে সংখ্যাটা দ্বিগুণের বেশি। জজের সংখ্যা ভারতে প্রতি লক্ষে মাত্র দুই দশমিক এক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যাটা পনেরো! ভারতে জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তার, শিক্ষক, টাউন প্ল্যানার, পুলিশ, জজ, ফায়ারফাইটার, ফুড অ্যাণ্ড ড্রাগ ইন্সপেক্টর, রেগুলেটর ইত্যাদির সংখ্যা উন্নত দেশ তো বটেই, উন্নয়নের সমান ধাপে অবস্থিত অন্য দেশের তুলনাতেও কম!

জি-২০ গ্রুপে ভারতের সিভিল সার্ভেন্টের সংখ্যা হল সর্বনিম্ন। কর্মসংস্থানে পাব্লিক সেক্টরে নিয়োগ ভারতের ক্ষেত্রে ছয় শতাংশের কম, চীন বা ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় অর্ধেক, ইউকের তুলনায় বড় জোর এক তৃতীয়াংশ।
ভয়ের কথা হল ভারতের সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মসংস্থানে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। উনিশশো চুরানব্বইতে যেখানে মোট কর্মসংস্থানে কেন্দ্রীয় সরকারীর সংখ্যা ছিল সাড়ে বারো শতাংশর মত, দুহাজার বারোতে তা নেমে এসে দাঁড়ায় মাত্র সাড়ে আট শতাংশে। এর মধ্যে সর্বাধিকসংখ্যক কর্মী হলেন মিডল ম্যানেজমেন্টে বা সি লেভেলে। এঁদের সংখ্যা আরো কমবে, প্রযুক্তির প্রয়োগে বা ঠিকা কর্মী নিয়োগে। যেমন হয়েছে গ্রুপ ডি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে। ঠিক যেমনটি পঞ্চম বেতন আয়োগ সুপারিশ করেছিল।
বলা বাহুল্য, চাইলেই যেখানে কোটি ভারতীয় মামুলি স্তরের চাকরির জন্য উপস্থিত, সেখানে তিন গুণ বেতন দিয়ে একজন স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগের বদলে সামান্য বেতনে একজন অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ করাকে কীভাবে ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে? অষ্টম বেতন আয়োগ যদি আবার যাকে বলে ছপ্পর ফাড় বেতনবৃদ্ধি করে, তাহলে এই কর্মী সঙ্কোচন বা অস্থায়ী কর্মী দিয়ে কাজ চালানো যে আরো বাড়বে সেই আন্দাজ করার জন্য পুরস্কার লাগবে? সরকারকে তো ব্যয় সীমিত রাখতেও হবে!

এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। রাজনীতি এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু, বেশির ভাগ রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের এক সাধারণ ক্ষোভ লক্ষণীয়। তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের তুলনায় মহার্ঘ ভাতা ইত্যাদি কম পান বলে, তাঁদের বেতন প্রায় সব রাজ্যেই তুলনায় কম। অষ্টম বেতন আয়োগ এই বৈষম্য আরো বাড়ালে তো বিক্ষোভ সামলাতে হবেই রাজ্যগুলিকে। আর, বহু রাজ্যেই ভাঁড়ারের যা অবস্থা, আরো বেতন বাড়াতে গেলে ঋণ করিয়া বেতন দিবেক অবস্থা ঘোরতর হবে। অথচ, অষ্টম বেতন আয়োগ সম্বন্ধীয় সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে রাজ্যগুলির মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না! উল্লেখ্য, বেতনবৈষম্য নিয়ে রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা যেমন সোচ্চার, বেসরকারী ক্ষেত্রে তেমনই তার ঢের বেশি হতাশা ও বিরোধ আছে। বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ চান, প্রকৃত আর্থিক সংস্কারের নমুনা রেখে, এই বেতন আয়োগে সরকারী বেতন কমানো হোক! কিন্তু, আমলাতন্ত্রর কাছে সেই দাবী বাতুলতা নয়? আপাতত, বেতনক্রমে স্থিতাবস্থা রেখে সরকারগুলি শূন্যপদে নিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মনোযোগ বাড়ালেই যথেষ্ট হবে।