বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে কয়লার ব্যবহার বন্ধের কোনও সময়সীমার উল্লেখ নেই

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বর্তমানে ব্রাজিলের এমাজন জঙ্গলের কোলে অবস্থিত শহর বেলেমে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০ এর দ্বিতীয় সপ্তাহে সম্মেলনের যে খসড়া ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তাতে ফসিল ফুয়েল বা জীবাষ্ম থেকে আসা শক্তির (প্রধানত কয়লার) ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেবার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমার উল্লেখ দেখা গেল না। এক দশক আগে জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তিতে কয়লার অপসারণ বাস্তবে কার্যকর করে, গ্রিন গ্যাস নির্গমণের পরিমান কমিয়ে, বিশ্বে উষ্ণায়ন কমানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার এক দশক কেটে গেলেও এবারের কপ সম্মেলনের খসড়া প্রস্তাবে এই ব্যাপারে এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা বা সময়সীমার উল্লেখ পাওয়া গেল না। এটাও ঠিক যে গত বছরের কপ-২৯ এও কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনও সময় বেঁধে দেওয়া হয় নি।

এবারের এই জলবায়ূ সম্মেলনে প্রথম থেকেই যেখানে বলা হয়েছে যে পৃথিবীকে জলবায়ু দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কথা অনেক হয়েছে, এবার পৃথিবীর দূষণ রুখতে কিছু কাজের কাজ হোক, যার ফল চোখে দেখা যায়। কিন্তু খসড়াতে তো, ‘আসুন করে দেখাই’ – এর মত সুনির্দিষ্ট কোনও কর্মসূচির কথা তো বলাই হল না। মজার কথা যে এর আগের খসড়ায় এবারের সম্মেলনের সভাপতি ব্রাজিল ঢুকিয়েছিল যে এই বিষয়টির একটি রূপরেখা এবং সময়সীমার সংস্থান রাখা হোক। তবে উন্নতিশীল দেশগুলি স্বভাবতই এই নির্দিষ্ট রূপরেখা দেবার ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেয় নি। এখন দেখার যে খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করার দড়ি টানাটানির বৈঠকে দ্বীপরাষ্ট্রগুলি এবং অনুন্নত দেশগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করে পর্যায়ক্রমে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা মূল প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করাতে পারে কি না?

এবারের সম্মেলনের মূল চারটে প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে দূষণ রোধের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান, উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে কার্বন ব্যবহারের নিরিখে কার্বন বানিজ্যের সুঠাম একটি ব্যবস্থা প্রণয়ন, এই সংক্রান্ত কাজের স্বছতা এবং প্রত্যেক দেশ এই বিষয়ে কত অর্থ বরাদ্দ করবে তা সুনির্দিষ্ট করা। এই অর্থ বরাদ্দের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে পৃথিবীর উষ্ণায়ণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সত্যিই রাখা সম্ভব হবে কিনা।


প্রতিটি দেশের অর্থ বরাদ্দ ছাড়াও উন্নত দেশগুলি পরিবেশ দূষণ রোধের কর্মসূচিতে কতটা অর্থ উন্নতিশীল দেশগুলিকে দেয় সেটাও কপ-৩০ সম্মেলনের অন্যতম বিষয়। যেহেতু এবারে নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে দূষণরোধের কর্মসূচি গ্রহণের দিকে খুবই জোর দেওয়া হচ্ছে, সুতরাং এটা স্পস্ট যে কোনও কর্মসূচি বা প্রকল্প রূপায়নে অর্থটাই আসল এবং এর সিংহ ভাগই আসার কথা উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে। তবে অনুন্নত দেশগুলির অর্থ চাওয়া এবং উন্নত দেশগুলির এবিষয়ে নির্দিষ্ট অঙ্গীকার করা থেকে এড়িয়ে চলার বিষয়টি এখন প্রায় প্রতিটি কপ সম্মেলনেরই নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গতবার আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ-২৯ এর বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব বা বক্তব্য বা উপস্থিতি সেরকম খুব একটা জোরদার ছিল না। তবে এবারে ভারতের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ভুপেন্দ্র যাদব বেলেমে এসেছেন। ভারতের বক্তব্য আগেরবারের থেকে স্পষ্ট এবং জোরদার। ভূপেন্দ্র যাদব অবশ্য অর্থের ব্যাপারটাতেই বেশি জোর দিয়েছেন এবং পরিষ্কার বলেছেন উন্নত দেশগুলির অর্থ বরাদ্দ আর বিলিয়ন ডলারে রাখা যাবে না; আনতে হবে ট্রিলিয়ন ডলারে। ভারত তার যে সরকারি বক্তব্য পেশ করেছে তাতে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হবে তাতে একটা বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে একটা সমতা থাকতে হবে এবং প্রকল্পগুলি ন্যায়সঙ্গত হতে হবে। ভারতের আরেকটা বক্তব্য যে শুধু দূষিত গ্যাসের নির্গমণ কমানো নয় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষ তার জীবনযাত্রাকে খাপ খাওয়াতে পারবে কিভাবে সেটার দিকে অর্থাৎ এডাপ্টেশন বা অভিযোজনের দিকটাও ভাবতে হবে এবং তার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ভারত বলেছে উন্নত দেশগুলি শুধু অর্থ সাহায্য দিয়েই পার পেয়ে গেলে চলবে না; অনুন্নত ও উন্নতিশীল দেশগুলিকে এই বিষয়ের প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে যাতে তারা নিজেরাও পরিবেশ দূষণ রোধে উন্নত মানের প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। জীবাশ্ম থেকে আসা শক্তি বা ফসিল ফুয়েল অর্থাৎ কয়লার ব্যবহার ক্রমে ক্রমে কমিয়ে একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার আগে ভাবতে হবে যে এই পরিবর্তনের ফলে যেসব মানুষের জীবিকা চলে যাবে বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে, তাদের পুনর্বাসনের কথাও ভাবা দরকার। একদিকে যখন বিশ্বজুড়ে কয়লার ব্যবহার কমানোর কথা বলা হচ্ছে; অন্যদিকে কয়লার অন্যতম ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে ভারত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কিন্তু কয়লা বন্ধের সামাজিক সমস্যা নিয়েও সরব হলো যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে এবিষয় ভারত ঠিক কোথায় থাকতে চাইছে, ভবিষ্যতে কী করতে চাইছে সেটা অবশ্যই আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার। ভারত এবারের কপ-৩০ শে আর যে দাবি তুলেছে তা হল যে উন্নতিশীল বা অনুন্নত দেশগুলি যাতে তাদের পরিবেশ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ নিজেরাই করতে পারে তার অধিকার তাদেরকেই দিতে হবে। অর্থাৎ অন্য কোনও দেশের তৈরি করা নীতি অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশগুলির ওপর যাতে আর চাপিয়ে না দেওয়া হয়, ভারতএই সম্মেলনে সে ব্যাপারেও সোচ্চার হয়েছে। ভারত বলতে চেয়েছে, কোনও বিশেষ একটি দেশের পক্ষে কোনটা ভাল আর কোনটা করা সম্ভব সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা এবং অধিকার যেন প্রতিটি দেশের থাকে।

কপ-৩০ এর দ্বিতীয় সপ্তাহের পর্যালোচনা করতে গেলে অবশ্যই একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয় যে বৃহস্পতিবার কপ-৩০ এর অধিবেশনস্থলে আগুন লেগে যায়। কর্মীদের তৎপরতা এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় আগুন আর ছড়ায় নি এবং কিছু সময়ের মধ্যেই তা নিভে যায়। জনা তের লোকের শরীরে শুধু ধোঁয়া ঢুকে যায়। অধিবেশনের কাজ অবশ্য ব্যাহত হয়। তবে এমনিতেই কপ বৈঠক প্রতিবারই নির্দিষ্ট দিনের থেকে একদিন অন্তত বেড়ে যায়, তাই এবারেও সেরকম একদিন বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

গতবারেও কপ সম্মেলনের সময়েই জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির শিখর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবারেও শুক্রবার থেকে তা শুরু হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে। সেখানে ভূ-অর্থনীতির নানা বিষয়ে আলোচনা হবে। তবে অবশ্যই পরিবেশ দূষণ রোধে অর্থ বরাদ্দ, জীবাষ্ম থেকে আসা শক্তির ব্যবহার কমানো ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা হবে। জি-২০ শিখর সম্মেলনে যেহেতু এই একই সময়ে অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এক জায়গায় জড়ো হন, তাই জি-২০ সম্মেলনের কিছুটা প্রভাব যে কপ-৩০ সম্মেলনে, বিশেষত তার সিদ্ধান্তগুলিতে পড়বে তা মনে করা যেতেই পারে।

সব মিলিয়ে এবারের কপ-৩০ সম্মেলরও পরিবেশ দূষণ রোধে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ঘোষণা এবং তার রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে কতটা সক্ষম হয় তার ওপরেই এই সম্মেলনের সাফল্য নির্ভর করছে।