চলতি অর্থবর্ষে (২০২৫-২৬) কেন্দ্রীয় বাজেটে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজের জন্য কোনও অর্থই বরাদ্দ করা হয়নি। এখন মাঝপথে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ করে সেই সমস্যা সমাধানে হয়তো আগ্রহী নয় কেন্দ্র। কিন্তু সেই পরিকল্পনার কথা প্রকাশ্যে না জানিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নানা অছিলা তৈরির চেষ্টা করছে। আগামী বছরের গোড়ার দিকে রাজ্য বিধানসভার ভোট হতে পারে। তার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে পরের আর্থিক বছরের বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে বন্ধ থাকা প্রকল্প ফের চালু করার নির্দেশ দিতে পারে কেন্দ্র। এর অর্থ, আদালত যাই নির্দেশ দিক, এখনই রাজ্যে ১০০ দিনের কাজ শুরুর সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
মূলত চারটি জেলায় ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০২১ সালে টাকা আটকে রেখে গোটা রাজ্যে প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয় কেন্দ্র। একাধিকবার রাজ্যে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে কেন্দ্র অভিযোগ খতিয়ে দেখে শুধরে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে রাজ্যকে। নবান্ন সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু তারপরেও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাজ্যকে বিপাকে ফেলতে ফের প্রকল্প চালু করতে অস্বীকার করে কেন্দ্র। এর বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়। আদালত ১ আগস্ট থেকে কাজ চালু করার নির্দেশ দেয়। আদালতের যুক্তি ছিল, দুর্নীতি রুখতে রাজ্য সরকারকে যে কোনও শর্ত দিতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু গোটা রাজ্যে কাজ আটকে রাখা যাবে না। আদালত প্রশ্ন তোলে, দুই সরকারের বিরোধে কেন সাধারণ মানুষ ফল ভুগবে। প্রয়োজনে ওই চার জেলাকে বাদ দিয়ে রাজ্যের বাকি অংশে এই কাজ চালু করতে হবে। জনস্বার্থেই এই কাজ চালু হওয়া দরকার। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায় কেন্দ্র। শীর্ষ আদালত কার্যত কেন্দ্রের আবেদনকে গুরুত্ব না দিয়ে মামলাটি খারিজ করে দেয় গত মাসের শেষের দিকে। অগত্যা মামলাটি আবার ফিরে আসে হাইকোর্টে। রাজ্যের আদালত কোনও সময় নষ্ট না করে দ্রুত ১০০ দিনের কাজ শুরু করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তাতেও কর্ণপাত করছে না কেন্দ্রের মোদী সরকার।
পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজ (মনরেগা) বন্ধ হয়েছে ২০২২ সালে । তার আগে পর্যন্ত এই খাতে কেন্দ্রের কাছে বাংলার হকের পাওনমা আটকে ছিল ৬,৯১৯ কোটি টাকা। স্বাভাবিক নিয়মে তারপরে বাংলার জন্য শ্রম বাজেট বরাদ্দ হলে রাজ্য আরও ৫০,৩৪৪ কোটি টাকা পেত। কিন্তু রাজ্যকে তার পাওনা অর্থ দেয়নি কেন্দ্রের মোদী সরকার। এই অর্থ রাজ্যে আসার অর্থ হলো বাংলার গরিব মানুষগুলি হাতে হাতে কাজ পেতেন। মহাত্মা গান্ধীর নামাঙ্কিত এই কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প কংগ্রেস আমলে চালু করার উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা বৈষম্য ও বেকারত্ব। এর প্রধান বলি অবশ্যই গরিব মানুষ। এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি গ্রাম ভারতে। তাই এমন একটি আইন তৈরি করা হয়েছে, যাতে গ্রামের গরিব মানুষের দাবি অনুযায়ী তাঁকে বছরে অন্তত ১০০ দিনের কাজ দিতে বাধ্য থাকবে সরকার। গত দুই দশকে ভারতে দারিদ্র্য অবশ্যই কিছুটা কমেছে। এর পিছনে মনরেগা প্রকল্প রূপায়ণে বেশ গতি ছিল। জনমুখী প্রকল্পটির দফারফা করা হয়েছে মোদী আমলে। যখন কাজের দিন বৃদ্ধির দাবি জোরালো হচ্ছে, তখন এই খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। তারই মধ্যে চলেছে ‘সিঙ্গল ইঞ্জিন’ সরকারগুলির সঙ্গে চরম বঞ্চনার খেলা। অবিজেপি সরকারগুলির মধ্যে মোদী-শাহের সবচেয়ে অপছন্দের রাজ্য হল পশ্চিমবাংলা। কারণ এই সরকারের শীর্ষে রয়েছেন আপসহীন প্রতিবাদী মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি দিল্লির যে কোনও অনাচারের কট্টর সমালোচক। তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াইয়ে বারবার পিছু হটে বস্তুত বাংলার গরিব মানুষগুলিকেই কষ্ট দিয়ে চলেছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। দুর্নীতির অজুহাত খাড়া করে এখানে মনরেগার কাজ ও টাকা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। তার ফলে লক্ষ লক্ষ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আগেই বাংলার মানুষের দাবিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। ১৮ জুন কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ১ আগস্ট থেকে বাংলায় মনরেগার কাজ শুরু করতে হবে।
দীর্ঘ টালবাহানার শেষে পশ্চিমবঙ্গের মনরেগা শুরুর ফাইলে সই করলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কবে তা শুরু হবে, মন্ত্রী খোলসা করে কিছু বলেননি। ১৮ জুন কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ১ আগস্ট বাংলায় মনরেগার কাজ শুরু করতে হবে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টেও খারিজ হয়েছে কেন্দ্রের আর্জি। এরপর বিষয়টি নিয়ে পিএমও-র সঙ্গে আলোচনা শুরু হয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের। পিএমও-র সবুজ সংকেত পেয়েই বিভাগীয় মন্ত্রী ফাইলে সই করেন। বাংলার মানুষকে বঞ্চনা করার জন্য যে এটা পরিকল্পিত চক্রান্ত, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও মানবাধিকার ধ্বংসের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সংকীর্ণ রাজনীতি ছেড়ে অবিলম্বে শুরু হোক বাংলায় মনরেগার কাজ। কেন্দ্রের বাধা সত্ত্বেও জনস্বার্থে রাজ্য সরকার নিজেদের তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করে এই প্রকল্প চালু রেখেছে।