অক্টোবরের মাঝামাঝি বর্ষা বিদায় নিল। কিন্তু এবার বর্ষা দেখিয়ে গেল কত ভয়ঙ্কর যে হতে পারে। প্রকৃতির রোষের কাছে মানুষ অসহায়। এবার বর্ষার প্রকৃতি তার রুদ্ররূপ দেখাল। সে রূপ ভয়ঙ্কর। অবিরাম বারিধারায় পুরো উত্তরবঙ্গ এবং পাহাড়ি অঞ্চলে মানুষ চরম দুর্গতির শিকার হল। উত্তরবঙ্গ জলে ভাসল। অনেক বাড়িঘর বন্যার জলের স্রোতে ভেঙে পড়েছে। ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেক মানুষকে। তাঁদের ঘরবাড়ির চিহ্ন থাকল না— প্রবল বর্ষণের জেরে যে প্লাবনের সৃষ্টি হল, তা ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাঁদের বাড়ির বাড়ির আসবাবপত্র। অনেক মূল্যবান জিনিস গ্রাস করল প্রকৃতি। বর্ষার জলে এই ধরনের প্লাবনের সৃষ্টি হবে, তা ভাবতে পারেননি উত্তরবঙ্গে বসবাসকারীরা। পাহাড়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের জেরে ধস নামল— রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। যে সব পর্যটকরা উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন তাঁরা আটকে পড়ল। কারণ ফেরার ব্যবস্থা নেই। বাস, গাড়ি চলাচল সব বন্ধ। পাহাড়ি অঞ্চলেও মানুষ আটকে রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ ধস নামার ফলে পরিবহণ বিপর্যস্ত। ভারী বর্ষায় উত্তরবঙ্গে প্রকৃতির এমন রোষে পড়বেন, তা ভাবতে পারেননি উত্তরবঙ্গবাসীরা। খাবার নেই, পানীয় জল নেই, দোকানপাট সব বন্ধ— অনেক দোকান জলের তলে। বন্যার জলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেককে— বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী অনেককে উদ্ধার করল। অনেকের খোঁজ পাওয়া গেল না। প্রকৃতি যে এমন নির্দয় হবে, উত্তরবঙ্গবাসীদের ওপর তা তাঁদের ভাবনার বাইরে ছিল। বর্ষার পর এখন হেমন্ত। হেমন্তের উপস্থিতি আমরা টের পাই না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও হেমন্তের ওপর কোনও গান রচনা করেননি। হেমন্ত নিঃশব্দে আসে, নিঃশব্দে চলে যায়। তারপর শীত।
উত্তরবঙ্গে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে এই ভয়াবহ দুর্যোগের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কার্নিভাল অনুষ্ঠান শেষে তিনি ছুটে যান উত্তরবঙ্গে। অন্য সময় মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝেই উত্তরবঙ্গে যান। যান পাহাড়ি অঞ্চলেও। উত্তরবঙ্গের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর টান রয়েছে— তাই দুই-তিন মাস অন্তর অন্তর তিনি সেখানে যান। উত্তরবঙ্গবাসীর স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের জন্য তিনি নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। সুতরাং এই দুর্যোগের দিনে তিনি সেখানে গিয়ে ঘরছাড়া মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাঁদের সান্ত্বনা জানালেন। বললেন, সরকার তাঁদের পাশে আছে। স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেন, কীভাবে উদ্ধারকাজ চালাতে হবে। যাঁরা ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা খাবারাদি ঠিক মতো পাচ্ছে কিনা, তার খোঁজখবর নিলেন। অবস্থা একটু স্বাভাবিক হতে তিনি পর্যটকদেরও ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন।
শুধু উত্তরবঙ্গ নয়। এবার শহর শিল্পাঞ্চলও বুঝিয়ে দিল সে কত ভয়ঙ্কর। একদিনের প্রবল বর্ষায় ভাসল শহর। এক ডজনেরও বেশি মানুষ মারা গেলেন। শহরবাসী নিদারুণ দুর্যোগের মধ্যে পড়লেন। পরিবহণ বটে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। জল ঘরবাড়িতে ঢুকে যাওয়ায় বসবাস কঠিন হয়ে ওঠে। তাঁদের জন্য শিবির খুলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। শহরের সর্বত্র জলে জলময়। শহরের যেসব অঞ্চলে প্রবল বর্ষণেও জল জমে না, সেসব অঞ্চলেও জলে থইথই। কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম জানালেন, এমন প্রবল বর্ষণ তিনি জীবনে দেখেননি।
প্লাবনের পরের দিন মানুষ দেখল পুরো শহরই জলে ভাসছে। অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নানা ব্যবস্থা নিলেন। তিনি প্লাবনের জন্য সরাসরি দায়ী করলেন ডিভিসি কর্তৃপক্ষকে। তিনি বললেন প্রতিবারই বর্ষায় ডিভিসি-র জলাধারগুলি থেকে সরকারকে সময়মতো না জানিয়ে জল ছাড়ার জন্য এই বিপর্যয়। ডিভিসি-র জলাধারগুলিতে পলি পড়ে পড়ে তার জল ধারণ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। জলাধারগুলি থেকে পলি না সরানোর জন্যই বেশি বৃষ্টি হলে, বিশেষ করে ঝাড়খণ্ডে, জলাধারগুলিতে জমা জল বিপদসীমার উপরে চলে যায়। তখন এই অতিরিক্ত জল ছাড়া হয়। যার ফলে রাজ্যের অনেক জেলায় প্লাবন দেখা দেয়। ব্যাপক শস্য হানি হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও জানিয়েছেন, ডিভিসি তার জলাধারগুলিকে সংস্কার না করার জন্য অতিরিক্ত জল ছাড়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় প্রতি বর্ষায় প্লাবন দেখা দেয়। তাতে ব্যাপক শস্যহানি তো হয়ই, মানুষের ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে হয়। বছরের পর বছর ড্রেজিং না করার জন্য জলাধারগুলি জল ধারণের ক্ষমতা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু ডিভিসি কর্তৃপক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ স্বীকার করে না। তাঁরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গকে সময়মতো জানিয়েই অতিরিক্ত জল ছাড়া হয়। বর্ষা তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিল। এমন বর্ষা যেন ভবিষ্যতে আর না হয়। এখনও ছন্দে ফেরেনি উত্তরবঙ্গ, পাহাড়ি অঞ্চল।