নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম প্রচারক না হয়ে হলেন হিন্দু ধর্মের প্রচারক

ফাইল চিত্র

ড. বিমলকুমার শীট

উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ ও ধর্মসংস্কারের কারণে স্মরণীয়। এই শতাব্দীর পরিস্থিতিতে সমাজকে রক্ষা করার জন্যই ব্রাহ্মসমাজের উদ্ভব। ব্রাহ্মসমাজ ভারতের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে ছিল। ব্যক্তি স্বাধীনতাকে এই সমাজ যথেষ্ট মর্যদা দিয়েছে। ব্রাহ্মসমাজ বাংলায় প্রবাহিত হয়ে ধনী ও নির্ধন, বিদ্বান ও মুর্খ, ব্রাহ্মণ ও শূদ্র সকলকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে ছিল। উদ্বেলিত করে তুলে ছিল যুব চিত্তকে। রাজা রামমোহন রায় থেকে কেশবচন্দ্র সেন পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন রূপে প্রবল আকার ধারণ করে। সেকালে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, কৃষ্ণকুমার মিত্র, সত্যজিৎ রায়, আনন্দমোহন বসু, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, রাজনারায়ণ বসু, উমেশচন্দ্র দত্ত, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৮৯২ সালে বাংলায় ব্রাহ্মসমাজের সংখ্যা ৬১টি থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২৪টি। নরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৩-১৯০২) যিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে ছিলেন, তিনিও এক সময় ব্রাহ্মসমাজে ভিড়লেন। পরে অবশ্য হলেন হিন্দুধর্মের প্রচারক এবং নবভারত সৃষ্টির প্রবর্তক।

সেকালে আদি ব্রাহ্মসমাজ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথেরও (১৮৬১-১৯৪১) আগ্রহ জন্মেছিল। তাই মৃতপ্রায় আদি ব্রাহ্মসমাজের পুনরায় প্রাণসঞ্চার করার জন্য পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথকে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার’ সম্পাদক ও রবীন্দ্রনাথকে আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পদে নিযুক্ত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হয়ে নিজ কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন। ব্রাহ্মধর্ম সম্বন্ধে তিনি লিখলেন,- “প্রত্যেক জাতি বিশেষ সাধনা অনুসারে বিশেষ ফল প্রাপ্ত হয়, সেই ফল তাঁহার অন্য জাতিকে দান করে। এইরূপে সমস্ত পৃথিবীর উপকার হয়। আমাদের এত সাধনার ফল কি আমরা ইচ্ছাপূর্বক অবহেলা করিয়া ফেলিয়া দিব ? এই জন্যই বলি ব্রাহ্মধর্ম পৃথিবীর ধর্ম বটে, পৃথিবীকে আমরা এই ধর্ম হইতে বঞ্চিত করিতে পারিও না চাহিও না, — ব্রাহ্মধর্মের জন্য পৃথিবী ভারতবর্ষের নিকট ঋণী” (১৭ জানুয়ারি ১৮৮৫)।


তরুণ বয়সে নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। তরুণ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে এটা সে যুগে মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। তিনি কেশবচন্দ্র সেন এবং পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ) সংস্পর্শে আসেন। এরপর নরেন্দ্রনাথ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হন। তাঁর ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন,- “সম্ভবত কেশবচন্দ্রের রহস্যবাদ তাঁর কাছে অত্যাধিক অযৌক্তিক মনে হয়েছিল। তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা সঙ্গীতেও যোগ দিতেন”। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী একবার ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে বলেছিলেন,-“তোমার ভাই আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে তোমার বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ছিলেন”। হরমোহন মিত্র ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে প্রায়ই বলতেন,- “স্বামীজি বললেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে আমি একজন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হতুম”। নরেন্দ্রনাথ সে যুগে একজন উৎসাহী ব্রাহ্ম ছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্তর্নিহিত মনোভাবের পরিবর্তন হয় নি। ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে নরেন্দ্রনাথ সে যুগে একজন উৎসাহী ব্রাহ্ম ছিলেন। তিনি সমাজ সংস্কারক থেকে পরিণত হয়ে ছিলেন একজন সমাজ বিপ্লবী রূপ।

স্কটিশ মিশনারি রেভারেণ্ড আলেকজাণ্ডার ডাফের প্রতিষ্ঠিত জেনারেল এসেম্বলি কলেজে অধ্যয়নকালেই তাঁর সঙ্গে রামকৃষ্ণের পরিচয় হয়। নরেন্দ্রনাথের সহপাঠী হরমোহন মিত্র এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ছাত্ররা ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বুঝতে পারেনি বলে একদিন আমাদের ইউরোপীয় অধ্যাপক ছাত্রদের ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তিনি রেগে গিয়ে টেবিল চাপড়ে, বুট দিয়ে পাদানি ঠুকে শেষ পর্যন্ত ক্লাস ছেড়ে চলে গেলেন। এমন সময় আমি কোনো একটা কাজে ক্লাসঘর থেকে বাইরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি দেখলাম প্রিন্সিপ্যাল রেভারেন্ড হেস্টি ক্লাসঘরের দিকে গট গট করে আসছেন। আমি ফিরে এলাম এবং হেস্টির বক্তৃতা শুনলাম।

তিনি বললেন, ‘অমুক অধ্যাপক বলেন যে, ছাত্ররা নির্বোধ তারা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা বুঝতে পারে না সম্ভবত তিনি নিজেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ বোঝেন না। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মাঝে মাঝে সমাধি (Trance) হয়ে যেত ইত্যাদি”। বক্তৃতার শেষে তিনি বললেন, “এমনি ধরনের এক ব্যক্তি দক্ষিনেশ্বরে আছেন যিনি সমাধি প্রাপ্ত হন। তোমরা গিয়ে তাকে দেখে এস”। তারপর নরেন্দ্রনাথ দক্ষিনেশ্বরে যান।

ভিন্নমতে নরেন্দ্রনাথ যখন ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করছেন তখন একদিন তাঁর আত্মীয় ডাঃ রামচন্দ্র দত্ত তাঁকে বললেন, তিনি কত জায়গায় যান অথচ রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখতে যান না কেন? ভূবনেশ্বরী দেবী বলেছেন যে, এই রামচন্দ্র দত্তই নরেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণের কাছে নিয়ে যান। রামকৃষ্ণের জীবনীকারেরা লিখেছেন, নরেনের প্রতিবেশী সুরেশচন্দ্র মিত্রের গৃহে রামকৃষ্ণ এসে ছিলেন। সুরেশচন্দ্র তখন নরেন্দ্রনাথকে আমন্ত্রন করলেন গান গাইতে। তখন থেকেই দুজনের পরিচয়ের সূত্রপাত। তারপর নরেন্দ্রনাথ নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত করতে থাকে।

এরপর নরেন্দ্রনাথের জীবন অন্যখাতে বইতে থাকে। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের (১৮৮৬ সাল) সংকল্প গ্রহণ করেন। তারপর তিনি ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। তিনি মাদ্রাজে এলে মাদ্রাজী ভক্তগণ তাঁর জন্য পাশ্চাত্যগমণের ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থসংগ্রহ করেন। এরপর স্বামী বিবেকানন্দ পেনিনসুলার জাহাজে বোম্বাই থেকে বিদেশ যাত্রা করেন। ১৮৯৩ সালে ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে ভাষণদান করে ভারতের মুখ উজ্বল করেন।