ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় দোলে আমার প্রাণ

প্রতীকী চিত্র

রতন ভট্টাচার্য

‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় দোলে আমার প্রাণ’। ফাগুন মানে বসন্ত আর বসন্ত মানে পলাশের রং আর দোলের রং মেখে রঙিন হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর অনুভব। টিভিতে গান হচ্ছে ‘বসন্ত এসে গেছে’। আর বসন্ত এলেই আমার মনে পড়ে সুনীলের নীরাকে, আর নীরা মানে প্রেম, প্রাণের উৎসব। নীরা আর দোল— খুব কাছের মনে হয় আমার। রঙিন হয়ে ওঠে আবেগ, ঠিক যেমন দোল এলে হয়। নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।

নীরা, তোমায় দেখি আমি সারা বছর/ মাত্র দু’দিন
দোল ও সরস্বতী পূজোয়– দুটোই খুব রঙের মধ্যে


রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে সারা বছর মাত্র দু’দিন— নাছোড়বান্দা দোল। প্রেম, রং, গান, বিষাদ আর রিক্ততার দোল। সে কালের রাধাই হোক বা এ কালের রুপস (রুপসা), রঙের হাতে ধরা পড়লে তার আর নিস্তার নেই। আবিরে, আগুনে, দহনে ফুল ফোটার সঙ্গে ফুল ঝরার খেলা। একদা রাধা-কৃষ্ণের বাঁধনছেঁড়া প্রেমযাপনের উৎসবই তো শুনিয়েছিল হাজার কোকিলের দোল খেলার ডাক। ‘লাগল যে দোল’ বলে নেচে ওঠার সরাসরি সম্প্রচার দেখানোর অগুন্তি চ্যানেল তখনও জন্ম নেয়নি, তবু আমবাঙালির তাবৎ অশান্তিনিকেতনেও ওই একটি দিনের গায়ে লেগে থাকত কাঁচা হলুদ রং। তবে শরীর থেকে মনে পৌঁছনোর যে রাস্তা সে বেছে নিত, তার নাম, ‘গান’। সকাল থেকে সন্ধ্যা হাওয়ায় শুধু আবীর নয়, শরীর মিশে যেত গানের নেশায়। শান্তিনিকেতনে পা রাখলেই যা বসন্তোৎসব। আবিরে ভেসে যাওয়া, রঙের খেলা, বাঙালির ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্যদেব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। ইংরেজি সাহিত্যে চসার Canterbury Tales এর শুরুতে বসন্ত আর ক্যান্টারবেরি চার্চ এ তীর্থযাত্রার আনন্দ মিলিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটা সেইরকম। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে থেকেই হোলি উদযাপিত হয়ে আসছে। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্ট জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদই করা একটি ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরাণেও। ৭০০ শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতেও হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে। ইংরেজরা প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবে মনে করত। গ্রীকদের ব্যাকানালিয়া উত্সবও তুলনা করা যায়। বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতেও এই উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘কামসূত্রে’ দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা জানতে পারি। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব রয়েছে।

অঞ্চলভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু উদযাপনের রীতি এক। বাংলায় আমরা বলি ‘দোলযাত্রা’ আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে ‘হোলি’। দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংশা’য় রঙ উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। এমনকি আল-বিরুণির বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সংযুক্ত হতেন। দোলযাত্রা মূলত একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব বলেই বিবেচিত। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। দোল উৎসবের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন রাধা-কৃষ্ণ। তাঁদেরকে দোলায় বসিয়ে পূজা করা হয়। উত্তর ভারতে যেটি হোলি নামে পরিচিত, বঙ্গদেশেই তার পরিচিত নাম দোল। হোলি উদ্‌যাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলো মূলত দুই প্রকার— প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত, এবং দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনি।

অনেক কাহিনি দোলকে ঘিরে রয়েছে। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর কাহিনি আমরা সকলে জানি। ভক্ত প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্ম নিয়েও পরম ধার্মিক ছিলেন। তাঁকে যখন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও হত্যা করা যাচ্ছিল না তখন হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ হোলিকা এই বর পেয়েছিলেন যে আগুনে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু অন্যায় কাজে শক্তি প্রয়োগ করায় হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করলে বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুণ্ড থেকেও অক্ষত থেকে যান আর ক্ষমতার অপব্যবহারে হোলিকার বর নষ্ট হয়ে যায় এবং হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যান। এই থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি। আবার বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলনায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়।

হুতোম প্যাঁচার নকশা বলছে, জেলেপাড়ার সঙের পথে নামার কথা। ইতিহাস বলছে, রাজা নবকৃষ্ণ দে-র বাড়িতে দোলের সন্ধের বাঈনাচের কথা— যেখানে সব দর্শক কনিয়াক হাতে সাহেবসুবো। শুধু হিন্দুরা নন, দোলের রঙে বহু যুগ ধরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে আনন্দ উপভোগ করেছেন। শোনা যায়, মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগর চুক্তি সেরে তড়িঘড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন হোলি উৎসবের জন্য। নবাবের প্রিয় হিরাঝিল প্রাসাদে মহা সমারোহে হোলি উৎসব পালন করা হত। তেমনই ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান পটনা থেকে আগত শওকত জঙ্গের সঙ্গে সাত দিন ধরে মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল প্রাসাদে হোলি উৎসব পালন করেছিলেন। তবে শুধু নবাবরা নন, সেই প্রাচীনকাল থেকেই হোলি উৎসবে মুসলমানরাও যোগ দিতেন। তাই বলা যায় দোল বা হোলি ধর্মীয় অনুষঙ্গের আড়ালে থাকা এক সামাজিক অনুষ্ঠানও বটে, যার সর্বজনীন আবেদন আছে।

মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলির অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণের রঙ উৎসব। এই রাধা-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে হোলির যে অতি বৈষ্ণবীয় আচার তা অবশ্যই প্রশ্নযুক্ত। কেননা এটি শ্রীকৃষ্ণের জীবন ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা শ্রীকৃষ্ণ ১০ বছর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করার পর সেখানে তাঁর আর যাওয়াই হয়নি।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বগড়ী কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণরায়জীউ-র দোল আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। কৃষ্ণরায়জীউ-র মন্দিরটি ১৮৫৫-এ নির্মিত। শোনা যায় আগে রাধিকা মূর্তিটি ছিল না, পরে সেটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকেই প্রতি বছর দোলের সময় উৎসব ও মেলা হয়।

নদিয়া জেলার শান্তিপুরে বিভিন্ন গোস্বামী বাড়িতে এবং শ্যামচাঁদ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা। দোল উপলক্ষে এখনও পথে হরিনাম সংকীর্তনের মিছিল বের হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য শ্যামচাঁদ মন্দির প্রাঙ্গণে আজও দোল উপলক্ষে এক দিনের একটি মেলা বসে। তবে শুধু দোলের দিন নয়। শান্তিপুরে দোল উৎসব চলতে থাকে পূর্ণিমা থেকে রামনবমী পর্যন্ত। উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় দোলের দিন নয়, পঞ্চম দোলের দিন মধ্য ভাটপাড়া অঞ্চলে অমরকৃষ্ণ পাঠশালার কাছে বসে দোলের মেলা। আজও দাঁড়িয়ে অতীতের দোল মঞ্চটি। মেলার বিভিন্ন জায়গায় আউল, বাউল, ফকির, কিংবা সন্ন্যাসীদের আখড়া। তাঁরা গেয়ে চলেছেন ‘ভাবের গান’। এ মেলা যেন বৈরাগ্য আর আনন্দের এক মিলনক্ষেত্র।

কিংবদন্তি অনুসারে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় ভবানী পাঠক উত্তরবঙ্গ থেকে নারায়ণপুরে এসে কিছু দিন আত্মগোপন করেছিলেন। এক দিন সন্ধ্যায় তিনি দেখেছিলেন বহুমূল্য অলঙ্কারে সজ্জিতা এক নারী তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছেন পুকুরের দিকে। ভবানী তাঁকে দাঁড়াতে বললেও তিনি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলেন। এমনই এক সময় ভবানী পাঠক তাঁর তলোয়ার দিয়ে সেই নারীর উপর প্রহার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী সামনের পুকুরের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। ভবানী পাঠকও তাঁকে ধরার জন্য সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু সেই নারীর কোনও সন্ধান পেলেন না। বরং হাতে পেলেন একটি ছোট শিলাখণ্ড আর একটি ছোট দেবীর বিগ্রহ। সেই উপলক্ষেই মেলা বসে।

হোলিতে মদ, গাঁজা, ভাং খেতে হবে এরকম ভাবনার বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে বলিউড মার্কা ‘তেরে অঙ্গন মে’ গান আর নাচ দেখে। অনেক ঘটনাও ঘটেছে বিষাক্ত মদ খেয়ে মৃত্যু কবলিত হতে। আবার বিষাক্ত রঙের ব্যবহারও উচিত নয়। এমনকি বহু জায়গায় হোলিকা দহনের নামে গাছপালা যথেচ্ছ কেটে ফেলা হয় তাও উচিত নয়। তাই হোলি নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের অসামাজিকতা পরিহার করা জরুরি। আমাদের প্রজন্মের কাছে দোল প্রেমের সময়, একটু আবির গালে লাগিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া, ‘তোমাকে চাই’। অথবা গানের সুরে বাঁধন বা বসন খোলার ইঙ্গিত।

হলুদ শাড়িতে কয়েকগুচ্ছ মেয়ের, ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল’, শোলে’র, ‘হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়’ থেকে শুরু করে কাটি পতঙ্গ-এর ‘চাহে ভিগে রে তেরি চুনারিয়া, চাহে ভিগে রে চোলি’ আর সর্বোপরি, সিলসিলা’র রঙ্গ বরষে… আঠারো আনা বাঙালিয়ানায় ঢুকে পড়ল ‘রঙ্গ বরষে’ পরকীয়ার দোল। কিন্তু এই রঙের খেলাতেও থেকে গেল না ছাড়ার দুষ্টুমি! আসলে মাল্টিপ্লেক্স বা শপিং মল বা কফি শপ আসার আগের তিরিশ-চল্লিশ বছর ওই সুরে-সুরেই প্রেম আসত শহর বা শহরতলিতে, ‘রং শুধু দিয়েই গেলে/আড়াল থেকে অগোচরে” গানের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি দোলের দিন ছিল স্বাধীনতা দিবস! আজও সেই ট্রেডিশন সমানে চলছে। হোলির রঙে মেতে ওঠে তারুণ্য। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ— কী নেই। সুন্দরের স্বপ্নে রঙের খেলায় উত্তাল অঞ্চলগুলো হয়ে ওঠে যেন এক টুকরো রংধনু।