১৪৩২ শুভ হল না

ফাইল চিত্র

এবারের নববর্ষ শুভ নববর্ষ হিসেবে মুক্ত মনে উদার চিত্ত বরণ করে নিতে পারা গেল না। মানুষের মনে একটা অশান্তি, একটা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। শুভ হলেও তা তেমনভাবে জমল না। কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে যতটা না পুজোর ভিড়, তার চাইতে মানুষের বেশি উৎসাহ দেখা গেল কালীঘাট মন্দিরকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন কলেবরে সাজানো দেখতে। দক্ষিণেশ্বর ভবতারিণী মন্দিরে এবং বেলুড়ে পুজো দিতে মানুষের ভিড় অবশ্য দেখা গেল, তবুও তা অন্যবারের মতো নয়। রাজ্যের কোথাও অশান্তি হলে তা মানুষের মনে ছাপ ফেলে। তাই এটা হতাশার বর্ষ।

কেন এবার ১৪৩২-কে সেই উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে স্বাগত জানাতে পারল না? কারণ রাজ্যের কয়েকটা জেলায় ঘোর অশান্তি, হিংসার উন্মত্ততা মানুষের উৎসাহকে দমিয়ে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের সংশোধিত ওয়াকফ বিল, যা সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ক্রমে আইনে রূপান্তরিত হয়েছে— তার বিরুদ্ধে, বাতিলের দাবিতে সীমান্ত জেলা মুর্শিদাবাদ, মালদা এবং উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলাতে মানুষ পথে নেমে বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল। এই বিক্ষোভ ক্রমেই হিংসায় রূপ নেয়। উন্মুক্ত জনতা এক শ্রেণির মানুষের ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে। বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র, টাকাপয়সা দুষ্কৃতীরা লাঠ করে নিয়ে যায়। মানুষের ওপর আক্রমণ নেমে এলে তারা ঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। মুর্শিদাবাদের কয়েকটি স্থানে মারমুখী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চালায়। তাতে আশানুরূপ কাজ না হওয়াতে আধা সামরিক বাহিনী— বিএসএফকে নামানো হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ এবং বিএসএফকে শেষ পর্যন্ত গুলি চালাতে হয়— তাতে বেশ কয়েকজন আহত ও মৃত্যু হয়।

এই ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে উত্তর চব্বিশ পরগনার ভাঙড়েও। সেখানে আইএসএফ নেতা বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকির নেতৃত্বে এক বিশাল জনতা পুলিশের অনুমতি ছাড়া রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। একসময় তা পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষের রূপ নেয়। মারমুখি জনতা পুলিশের বাইক পুড়িয়ে দেয়। অশান্তি দমন করতে এখানেও পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়।


রাজ্যের এই কয়েকটি স্থানে ব্যাপক অশান্তির কারণে মানুষকে গভীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হয়। নববর্ষের আনন্দ মাটি হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপদ্রুত এলাকার মানুষদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এই ওয়াকফ আইন সংশোধন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি আশ্বাস দেন, সংশোধিত এই আইন রাজ্যে বলবৎ হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর এই আশ্বাস সত্ত্বেও হিংসা থামছে না। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ পরিকল্পিতভাবে একটি রাজনৈতিক দল— বিজেপি এই হিংসা ছড়াতে উস্কানি দিয়েছে। তাঁর আরও অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ, বিএসএফ বাচ্চা ছেলেদের পাঁচ-ছশো টাকা হাতে দিয়ে তাদের দিয়ে ইট-পাথর নিক্ষেপ করিয়েছে। তাঁর সরকার এর তদন্ত করবে। বিএসএফের বিরুদ্ধে এটা একটি বড় অভিযোগ, যা স্বাধীনতার পর এই প্রথম শোনা গেল। মুখ্যমন্ত্রী এখানেই থামেননি— তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনুরোধ করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ‘কন্ট্রোল’ করতে। তাঁর হাতে সব কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে— আর তিনি তার ব্যবহার করছেন বিরোধীদের বিরুদ্ধে। শাসক তৃণমূলের এক মুখপাত্র অভিযোগ করেছেন, বিএসএফ জওয়ানদের একাংশ বাংলাদেশের জঙ্গি ও দুষ্কৃতীদের সীমান্ত দিয়ে ঢুকিয়ে মুর্শিদাবাদে মানুষের হিংসার কাজে সাহায্য করেছে। বিএসএফের তরফ থেকে এর বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য শোনা যায়নি।

মুখ্যমন্ত্রী নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামেইমাম ও মোয়াজ্জেম সমাবেশে ভাষণ কালে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ শান্তির রাজ্য। এখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে বসবাস করেন এবং তাঁদের নিজনিজ ধর্ম পালন করেন। আপনারাও শান্ত থাকুন। এই বক্তৃতাকালেও তিনি বিএসএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। বিএসএফের জওয়ানরা সীমান্তরক্ষী। তাঁরা সামান্ত পাহারা দেয়, পাচার রোধ করে এবং বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা যাতে ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে না পারে তার জন্যই সচেষ্ট থাকে। মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জ এবং ধুলিয়ানে হিংসা দমনে প্রায় ১৭ কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী নিয়োগ করা হয়। কারণ রাজ্যের পুলিশ ব্যাপক হিংসার ঘটনা, সংঘর্ষ এবং লুঠপাট ঠেকাচ্ছে, তেমন জোরদার ভূমিকা পালন করতে পারছিল না।

মুর্শিদাবাদ জেলার উপদ্রুত এলাকায় প্রচুর মানুষ বিশেষ করে মহিলারা তাদের সর্বস্ব লুঠপাট হয়ে যাওয়ায় এবং তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করায়, তাঁরা প্রাণে বাঁচতে মালদার একটি স্কুলে আশ্রয় শিবিরে এসে অবস্থান করছে। তাঁদের বেশির ভাগই হিন্দু মহিলা। ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্ন্যাসীদের দেখা গেল তাঁদের মধ্যে খাবার ও শাড়ি বিতরণ করতে। সে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য। মহিলারা এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে নৌকায় মালদায় এসে আশ্রয় নেন। মুর্শিদাবাদে প্রচুর ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, তার বেশির ভাগ বেহাত হয়ে গিয়েছে।

এই ব্যাপক সংঘর্ষের পিছুনে রাজনৈতিক ইন্ধন কতটা ছিল, আমরা জানি না। তবে রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিবৃতি হিংসা বন্ধের সহায়ক হয়নি। তাঁরা অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী যেখানে কোনও হিংসার ঘটনা ঘটে, সেখানেই ছুটে যান। কিন্তু মুর্শিদাবাদে এত ব্যাপক হিংসার ঘটনা ঘটলেও এবং প্রচুর মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হলেও সেখানে তিনি এখনও পর্যন্ত যাননি অসহায় মানুষদের সমবেদনা জানাতে এবং তাঁদের পাশে দাঁড়াতে। তিনি তো রাজ্যের সর্বত্র ঘুরে বেড়ান— মুর্শিদাবাদে কেন গেলেন না? ভাঙড়ের ঘটনা ভয়াবহ। সেখানে ব্যাপক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও ভাঙড়ে ব্যাপক অশান্তি ছড়িয়েছিল— তা থেকে পুলিশ কোনও শিক্ষা নেয়নি, তা বোঝা গেল সাম্প্রতিক গণ্ডগোলের চেহারা দেখে।