চরম অজ্ঞতা

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ হিসেবে উল্লেখ করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম অজ্ঞতার পরিচয়ই কেবল বহন করে না; তার সঙ্গে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বাঙালি মুসলমান এবং বাংলা ভাষার প্রতি তাদের কি অসীম ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য।

‘বাংলাদেশি’ নামেও যেমন কোনও ভাষা নেই, অনুরূপভাবেই বাংলাভাষী মানেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অবশ্যই বাংলাদেশি নয়!

যে দেশের স্বাধীনতার জন্য যে জাতি ও ভূমি সর্বাধিক প্রাণ, রক্ত, ভূমি অকাতরে নিঃস্বার্থে বিসর্জন দিয়েছে এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় গান সৃষ্টির মাধ্যমে অসীম অবদান রেখেছে; সেই বঙ্গভূমি, বাঙালি এবং বাংলা ভাষার প্রতি ন্যাক্কারজনক অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ কেবল এক অতি লজ্জাজনক অধ্যায়ই না, তার সঙ্গে ক্ষমার অযোগ্য অপহরাধও বটে।


দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত কর্মীদের কবে মানবতার মৌলিক উপাদান (ধর্ম ও দেশের তুচ্ছ গণ্ডী অতিক্রম করে), ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, বহুভাষী বহু-ধর্মীয় এই দেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন ও সংবেদনশীল করে তোলা হবে এবং শেখানো হবে যে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর অন্ধ বদ্ধ কূপের বাইরে এক বিশাল বিবিধ ভারতবর্ষ স্বমহিমায় বিরাজ করে!

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি জানে যে তাদের রাজনৈতিক হর্তাকর্তাবিধাতারা নূতন দিল্লি থেকে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে ছুটে এসে ‘বাংলাদেশি’ ভাষায় স্লোগান দেওয়া আরম্ভ করে ফেলেছে ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রকৃত বাঙালিদের মন জয় করার লক্ষ্যে! সেই প্রকৃত বাঙালিরা যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে সেই কুখ্যাত বহিরাগত বাঙালি বিদ্বেষী ভাষা সাম্রাজ্যবাদী সাম্প্রদায়িক শিবিরকে এড়িয়ে চলে যারা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার কলঙ্কের সঙ্গে জড়িত, বংলা নবজাগরণের আদি পুরুষ রাজা রামমোহন রায়কে ‘ব্রিটিশদের চামচা’ রূপে আখ্যায়িত করে, ‘বিশ্বভারতী’ কে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান’ রূপে প্রচার করে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনকে ‘জমি চোর’ আখ্যায় ভূষিত করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাম্প্রদায়িক অশালীন ‘বেগম’ ‘দিদি ও দিদি…’ আওয়াজ তুলে কটূক্তি করে এবং লক্ষ কোটি টাকার ন্যায্য আর্থিক প্রাপ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করে!

উপরন্তু ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলিতে নিরীহ পরিশ্রমী সৎ বাঙালিদের মারধর, আটক করে পশ্চিমবঙ্গে তাড়িয়ে দেওয়া এবং প্রায়শই তাদের বাংলাদেশে নির্বাসিত করাই যেন যথেষ্ট ছিল না; এখন সেই দলেরই নেতৃত্বাধীন প্রশাসন বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি’ ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে স্পষ্ট ইঙ্গিতও দিয়ে দিল যে রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুভাষ বিবেকানন্দ সত্যজিৎ অমর্ত্যর ধ্রুপদী ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তারা ভারতবর্ষের অংশই নয়!

বিজেপি যতই পশ্চিমবঙ্গ বাঙালি এবং বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্য ও ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করছে, ততই তারা পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের জীর্ণ কফিনে অন্তিম পেরেক বিদ্ধ করে চলেছে কারণ গর্বিত বাঙালিরা আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে এ বহিরাগত বাঙালি বিদ্বেষী ভাষা সাম্রাজ্যবাদী সাম্প্রদায়িক দলকে চূড়ান্ত গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রদান করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে স্বরাজ্য স্বজাতি ও নিজ মাতৃভাষার এই নির্মম অবজ্ঞা ও অপমানের প্রতিশোধ রূপে (২০২১ সালের ২ মে-র চেয়েও অসীম গুণ অধিক প্রতিশোধ)! ‘জয় মা দুর্গা’ ‘জয় মা কালী’র চূড়ান্ত ভণ্ডামির প্লাবনও ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ঐতিহাসিক পরাজয় থেকে বাঙালি-বিদ্বেষীদের বাংলা-বিদ্বেষীদের রক্ষা করতে পারবে না!

আর এই বাংলা-বাঙালি-পশ্চিমবঙ্গ বিরোধী অপশক্তি যারা আমার বাঙালি ভাই-বোনদের তাদের নিজের দেশে অত্যাচার করছে—স্পষ্ট ভাষায় তাদের এই বার্তা প্রদান করা হোক যে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, ক্ষুদিরাম বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেনের ‘বাংলাদেশি’ ভাষায় কথা বলতে পেরে আমরা অত্যন্ত গর্বিত এবং ‘নতূন ভারতবর্ষে’ কোনও অপশক্তিই আমাদের সেই ‘বিদেশি’ ভাষা উচ্চস্বরে উচ্চারণ থেকে বিরত রাখতে পারবে না।