শোভনলাল চক্রবর্তী
রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তি নামে বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটির ইংরেজি অনুবাদ সহজলভ্য। মোহন ভাগবত মহাশয় ব্যস্ত মানুষ, বিশেষত এই মুহূর্তে তাঁর ব্যস্ততা তুঙ্গে। সঙ্ঘের শতবর্ষ পূর্তির ক্ষণ সমীপবর্তী। অনুষ্ঠান-উদযাপন উদ্যোগে, পরিকল্পনার নির্মাণে, বাস্তবিকই তাঁর অনেক কাজ। তার উপর বিষফোড়ার মতো রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচন। ফলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উদযাপনের সঙ্গে সন্তর্পণে ও সুকৌশলে জড়িয়ে নিতে হচ্ছে বঙ্গবিজয়-অভিমুখী কর্মসূচিকেও। সেই কর্মসূচির মধ্যে লাঠ্যৌষধি, হুজ্জতি-হুমকি ঔষধির অধিকার প্রধানত অধিকারী মহাশয়দের। আর, প্রধান সরসঙ্ঘচালক হিসাবে মোহন ভাগবতের কাজ ভিন্ন মার্গের— দিগ্দর্শন ও দর্শন উচ্চারণের।
আপাতত বঙ্গসমাজকে সঙ্গে পাওয়ার আত্যন্তিক বাসনায় তাঁর সিদ্ধান্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্গনটিকেই ভর করা। তাঁর বাণী: রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’ লেখা পড়ে বাঙালির তদনুসারে চলা দরকার। সেইমতো স্থানীয় ভিত্তিতে সমাজ গড়া দরকার। স্থানীয় নেতৃত্বের উপর ভর করা দরকার। এ দেশের ‘গ্রামে অলিতে গলিতে’ এমন নায়কের প্রয়োজন রয়েছে— আগে নাকি রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন, এখন মোহন ভাগবত বলছেন। প্রশ্ন হল, দুই জনেই কি এক প্রকার নায়কের কথা বলছেন? ব্যস্ত মানুষ ভাগবত বিলক্ষণ জানেন, এখনই দরকার, জরুরি দরকার, স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী নায়কদের, না হলে তাঁদের নির্বাচনী নৌকাটি তীরে ভিড়ানো অসম্ভব। তাই নায়কের সন্ধানে নেমে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি।
তাঁর এই বাণীর সামনে বাঙালি রাজনৈতিক ভাবে কী করবে, জানা নেই। তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈপ্সিত নায়কের প্রতি ভাগবতীয় আহ্বান শুনে কী করতেন, সেটা ভেবে নিয়ে বাঙালির প্রাথমিক কিছু কর্তব্য পালন না করলেই নয়। ভাগবত মহাশয় নিজে রবীন্দ্রনাথের ‘‘স্বদেশী সমাজ’’ পড়ার সময় পেয়েছেন কি না জানা নেই, পড়লে জানতে পারতেন ওই প্রবন্ধেরই আরও কিছু অতি জরুরি অংশ। জানতে পারতেন, কেবল স্থানীয় নেতৃত্বের উপর ভর করার কথাই সেখানে বলেননি রবীন্দ্রনাথ, ভারতবর্ষীয় সমাজের গতিমুখটি যেন সেই নেতা বা নায়করা রাখতে পারেন, সেটাও বলেছিলেন। কী সেই গতিমুখ?
“হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান খ্রীস্টান— সকলেই ভারতবর্ষে আসিয়া মিলিয়াছে। বিধাতা যেন একটা বৃহৎ সামাজিক সম্মিলনের জন্য ভারতবর্ষেই একটা বড়ো রাসায়নিক কারখানা খুলিয়াছেন।” ভাগবত-চালিত সঙ্ঘের মতো সম্প্রদায়কে মাথায় রেখেই বলেছিলেন যে “আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে নানা স্থানে ধর্ম ও আচার লইয়া যে-সকল ভাঙাগড়া চলিতেছে শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহার কোনো খবর রাখেন না। যদি রাখিতেন তো দেখিতেন, ভিতরে ভিতরে এই সামঞ্জস্য-সাধনের সজীব প্রক্রিয়া বন্ধ হয় নাই।” প্রসঙ্গত, ‘স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধের পরিশিষ্ট’ বলে আর একটি প্রবন্ধ, ওই একই আত্মশক্তি শীর্ষক গ্রন্থে যা সঙ্কলিত— ইংরেজি অনুবাদেও লভ্য হওয়ার কথা— সেখানে রবীন্দ্রনাথ আরও স্পষ্ট করলেন: “মুসলমান সমাজ আমাদের এক পাড়াতেই আছে, খ্রীস্টান সমাজ আমাদের সমাজের উপর বন্যার মতো ধাক্কা দিতেছে। প্রাচীন শাস্ত্রকারদের সময়ে এ সমস্যাটা ছিল না। যদি থাকিত, তবে তাঁহারা হিন্দুসমাজের সহিত এই সমস্ত পরসমাজের অধিকার নির্ণয় করিতেন, এমন ভাবে করিতেন যাহাতে পরস্পরের মধ্যে নিয়ত বিরোধ ঘটিত না।”
ভাগবতকে প্রশ্ন: ‘পরসমাজের’ সঙ্গে সম্পর্কটি তাঁরা কেমন ভাবে নির্ণয় করছেন যাতে গোটা দেশে এখন ‘বিরোধ’ নিয়ত পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে? মুশকিল হল, একশো একুশ বছর আগে, ১৯০৪ সালে ‘স্বদেশী সমাজ’ লেখার সময়ে লেখক ততখানি বোঝেননি যে ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ভবিষ্যৎটি কেমন হতে পারে। এই রাসায়নিক কারখানার দখল ‘অন্য’ হাতে চলে গেলে রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটিয়ে, ‘সামঞ্জস্য’-র ভিতরে আণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে বিচূর্ণ করে, তার জায়গায় বিদ্বেষ বিভাজনের তিক্ত-যৌগ উৎপাদন করে, তাকে ঔষধ হিসাবে কেমনধারা বণ্টন-সেবন চলবে দেশ জুড়ে। লেখক এও ভাবতে পারেননি যে তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শমথিত কথাগুলিকে এই ভাবে গ্রাস করতে আসবেন সেই ‘বিরোধ’-বণ্টনকারীরা।
সুতরাং, আজ লেখকের অবর্তমানে, যে বাঙালি সমাজ এই লেখকের লেখায়-ভাবনায় কিছুমাত্র উপকৃত— তার দায়িত্ব হওয়া উচিত, তিনি যা বলেছিলেন সে কথাগুলিকে বিকৃত বা বিধ্বস্ত না হতে দেওয়া। সম্প্রতি ভাগবত বলেন, ‘‘হিন্দু তাঁরাই, যাঁরা নিজেদের পথকে বিশ্বাসের পাশাপাশি অন্য ধর্মালম্বীদের পথকেও সম্মান জানান। হিন্দু রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার কোনও সম্পর্ক নেই। হিন্দু রাষ্ট্র মানে কাউকে বাদ দেওয়া বা অন্যদের সঙ্গে বিরোধ নয়। এ দেশে যখন হিন্দু শাসন ছিল, তখন শাসনের প্রশ্নে কোনও বিভেদ ছিল না। ভারতীয় ভূ-খণ্ডে গত ৪০ হাজার বছর ধরে থাকা মানুষের ডিএনএ এক। মিলেমিশে থাকাই আমাদের সংস্কৃতি। বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য রয়েছে। আর সেই ঐক্যের ফসল হল বৈচিত্র্য।’’
এই কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হিন্দুত্ববাদী বাস্তুতন্ত্রের অন্য নেতাদের সঙ্গে তুলনা করলে মোহন ভাগবতকে ধর্মনিরপেক্ষ সহিষ্ণুতার ‘পোস্টারবয়’ মনে হতে থাকে। এই যেমন, অমিত শাহ যেখানে কোনও তথ্যপ্রমাণের তোয়াক্কা না করেই বলে দিলেন যে, ভারতের পূর্বপ্রান্তের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জনসংখ্যার বিন্যাস পাল্টে গিয়েছে; সেখানে দিল্লিতে তিন দিনব্যাপী বক্তৃতামালার শেষ দিনে ভাগবত বললেন, সব ভারতবাসীরই তিনটি করে সন্তানের জন্ম দেওয়া উচিত। তিনটি, কারণ জন্মহারের রিপ্লেসমেন্ট রেট হল প্রত্যেক নারীপিছু ২.১টি সন্তান। ভাগবতের যুক্তিটি সারল্যে ভরপুর— বললেন, ০.১টি সন্তান আবার হয় নাকি! ২.১ মানেই তিন।
নাগপুরের পাঠশালায় সম্ভবত গড়ের অঙ্ক শেখানো হয় না; অথবা, দশমিকে থাকা সংখ্যাকে কী ভাবে ‘রাউন্ড অফ’ করা হয়, সে কথাও ছাত্রদের জানানো হয় না। কিন্তু, লক্ষণীয়, ভাগবতের তিন সন্তান নীতি ‘সব ভারতীয়’র জন্য। গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা যে শুধু হিন্দুদের চারটি করে সন্তান উৎপাদনের নিদান দিতে অভ্যস্ত, ভাগবতের পরামর্শ অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তার চেয়ে পৃথক। বস্তুত, জনসংখ্যা নিয়ে তাঁর এই অবস্থানটিই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঘোষিত অবস্থানের চেয়ে আলাদা— এই বক্তৃতায় তিনি ভারতের জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসাবে দেখেননি, বরং জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি কমাকেই দুশ্চিন্তার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, ভাগবত বুঝি সত্যিই গোটা দেশের কথা ভাবছেন। সম্ভবত, তিনি তা-ই ভাবছেন। তবে আশঙ্কা হয়, তাঁর কল্পনার ভারতের বৈধ নাগরিক হিসাবে তিনি শুধু হিন্দুদেরই দেখেন। কারণ, তাঁর বক্তৃতাতেই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, হিন্দুদের মধ্যেই সন্তানপ্রসবের হার কমেছে সবচেয়ে দ্রুত; অন্যদের ক্ষেত্রেও কমেছে বটে, কিন্তু ততখানি নয়। অর্থাৎ, উদারতার মিহি আস্তরণটি সরালেই ভাগবতের বক্তৃতাতেও স্পষ্ট হবে হিন্দুদের প্রতি সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধির আহ্বান।
‘জনসংখ্যার ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয়’— অর্থাৎ, জনসংখ্যায় যাতে হিন্দুর অনুপাত তিলমাত্র না কমে, তার জন্যই এই ডাক। ফারাক হল, অন্য নেতারা হিন্দুদের চারটি করে সন্তান উৎপাদনের আহ্বান জানান— কারণ, হিন্দুত্ববাদীদের প্রচলিত বিশ্বাস, প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত চারটি সন্তান, যদিও এই বিশ্বাসের কোনও পরিসংখ্যানগত ভিত্তি নেই। অনুমান করা চলে, হিন্দুত্ববাদের পরিসরে অমিত শাহ বা আদিত্যনাথ এখন ‘রাগী পুলিশ’; তাই ভাগবত ‘ভাল পুলিশ’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ। লক্ষণীয়, জন্মহার, জনসংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে সমগ্র বাগ্বিস্তারে ভাগবত এক বারও বলেননি যে, কেরলে মুসলমানদের জন্মহারের চেয়ে উত্তরপ্রদেশে হিন্দুদের জন্মহার বেশি। কথাটি তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই চেপে যেতে চান। কারণ, জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা যতই বলুন যে, জন্মহার ধর্মের উপরে নির্ভর করে না, করে উন্নয়নের অন্য একাধিক মাপকাঠির উপরে— হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যুক্তিই হল, মুসলমানরা অধিকসংখ্যক সন্তান উৎপাদন করে জনসংখ্যার বিন্যাস পাল্টে দিচ্ছে; তা ঠেকানোর দু’টি পথ: মুসলমান খেদানো, এবং হিন্দুদের সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি।
ভাগবতও রাজনীতির এই চেনা ছকটিই বজায় রেখেছেন তাঁর ভাষণে। গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের কাছে যে কোনও প্রশ্নই বিদ্বিষ্ট রাজনীতির। তার সবচেয়ে বড় বিপদ হল, প্রশ্নটি শুধুমাত্র ক্ষুদ্র রাজনীতির হয়ে উঠলে তার সম্বন্ধে অন্য আলোচনাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। দেশে জনসংখ্যার সামগ্রিক বিন্যাস, আঞ্চলিক তারতম্য, উন্নয়নের বিবিধ সূচকের সঙ্গে জনসংখ্যার বিন্যাসের সম্পর্ক— যে প্রশ্নগুলি নিয়ে প্রকৃতই আলোচনার প্রয়োজন, যে প্রশ্নগুলি ভারতের উন্নয়ননীতির আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে ওঠার কথা, সেগুলি ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। অমিত শাহর গরম, এবং মোহন ভাগবতের নরম অবস্থান আসলে একই হিন্দুত্ববাদী মুদ্রার দুই পিঠ। এবং, সেই মুদ্রাটি ভারতকে ক্রমেই অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়।