মোদীর আরএসএস ভজনা

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আরএসএস এবং জনবিন্যাস নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের অ্যাজেন্ডাকে স্বাধীনতা দিবসের সরকারি অনুষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) একশো বছর ধরে দেশের সেবা করে চলেছে। আরএসএস-এর স্বয়ংসেবকরা দেশের জন্য নিজেদের জীবন সমর্পণ করেছেন। আরএসএসের বিষয়টিকে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। উল্লেখ্য, সম্প্রতি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত প্রশাসনিক পদে থাকা ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বে সকলকে সরে যেতে হবে বলার পরই মোদীর মুখে হঠাৎ আরএসএস বন্দনা।

সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের ভিতরে বিভাজন তৈরির অভিযোগ হামেশাই আরএসএস-এর বিরুদ্ধে রয়েছে। মোদী সরকারের এক দশকে সেই কাজের গতি বিপুল হারে বেড়েছে। পাশাপাশি, স্বাধীনতার আগেও একই ধরনের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এবং সাম্প্রদায়িক হিংসা তৈরির পিছনে আরএসএসের ভূমিকা বহুচর্চিত। যে সংগঠন স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে, ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই থেকে হামেশা নিজেদের দূরে রেখেছে, তাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রধান সরকারি অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক সংবাদপত্রে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তাতে সবার উপরে বড় আকারে বীর সাভারকরের ছবি দেওয়া হয়েছে। গান্ধীজি, সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিং প্রমুখদের ছবি রাখা হয়েছে সাভারকরের নিচে।

এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কংগ্রেস, সিপিআইএম সহ বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি এবং ইতিহাসবিদরা এর তীব্র নিন্দা করেছেন। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আরএসএস-এর প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী মোদী শহিদদের স্মৃতি ও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনাকে অপমান করেছেন। এটি অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য এবং লজ্জাজনক। আরএসএস-এর এই সংগ্রামগুলিতে কোনও ভূমিকা ছিল না, বরং তারা ধর্মীয় ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অন্যান্য হিংসা উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে আরএসএস-এর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদরা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পর এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বলেছিলেন, আরএসএস-হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠনগুলি দেশে যে পরিবেশ তৈরি করেছিল, তারই পরিণতিতে গান্ধীজিকে হত্যা করা হয়েছে।


কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, আরএসএস-কে গৌরবান্বিত করা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে পরিকল্পিতভাবে বিকৃত করা। দুনিয়ার অন্যতম পুরনো এবং বৃহৎ ফ্যাসিবাদী এবং আধা সামরিক সংগঠন হলো এই আরএসএস। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে আরএসএস-এর প্রশংসা সাংবিধানিক, ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আরএসএস-কে তুষ্ট করার মরিয়া প্রচেষ্টা। আরএসএস এবং এর মিত্ররা ব্রিটিশের পদাতিক সেনা হিসাবে কাজ করেছিল। তারা কখনও স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয়নি এবং ব্রিটিশদের বিরোধিতা না করে গান্ধীজিকে বেশি ঘৃণা করত।

গান্ধীজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিংয়ের তুলনায় সাভারকারকে গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞাপন দেওয়াটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়, একটি পরিকল্পিত কাজ। সরকারের এই পদক্ষেপ ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের প্রতি ভারতবাসীর অঙ্গীকারকে দুর্বল করে। সাভারকর গান্ধী হত্যা মামলায় একজন অভিযুক্ত ছিলেন, যদিও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তাঁকে খালাস করা হয়েছিল। তবে কাপুর কমিশন সাভারকরের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রমাণগুলি তুলে ধরেছিল। যাঁরা সংবিধানেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চান, তাঁদের ন্যায়বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের এই উপহাসের দ্ব্যর্থহীন নিন্দা করা উচিত।

আরএসএস স্তুতি এবং সরকারি বিজ্ঞাপনে সাভারকরকে গুরুত্ব—সবটাই যে সুনিশ্চিতভাবে করা, তা স্পষ্ট হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী দেশের জনবিন্যাসের পরিবর্তন নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করছেন। দশকের পর দশক আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপি প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে অনুপ্রবেশ নিয়ে এক ধরনের ভাষ্য প্রচার করে থাকে। এর সঙ্গেই ধর্ম পরিবর্তন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সন্তান উৎপাদনের হারের ভিন্নতা প্রভৃতিকে যুক্ত করে তা দেশের নিরাপত্তা, রাজনীতি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিন্যাসের জন্য বিপজ্জনক বলে প্রচার চালায়। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের প্রশ্নটি সামনে আনা হয়।

সঙ্ঘবাহিনী প্রচার করে ভোটার তালিকায় নাম তুলে, সম্পদের বণ্টনের সুযোগ নিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায় এই অনুপ্রবেশকারীরা। আরএসএস-এর মতে, অনুপ্রবেশ এবং ধর্মান্তকরণ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিন্যাসের ভারসাম্য বদলে দেওয়ার বিপদ হিসাবে হাজির হয়েছে। গত এক দশকে এই প্রচার তীব্র করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা দখল নিয়ে নিচ্ছে। উল্লেখ্য, বিহারে ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া কমিশন। তাহলে কিসের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী অনুপ্রবেশকারী নিয়ে ভয় দেখাতে চাইছেন।