মোদির ‘গ্যারান্টি’র গ্যারান্টি

আবার এসে গেল লোকসভা নির্বাচন৷ পূর্ববর্তী দুটি লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজিমাত করেছিলেন৷ এবার তাঁর প্রচারের ক্যাচলাইন হল ‘গ্যারান্টি’৷ শুধু গ্যারান্টিতেই থেমে থাকছেন না, ‘গ্যারান্টিরও গ্যারান্টি’ দিচ্ছেন৷ এক আঙুল তুলে নিজস্ব ঢঙে কেটে কেটে বলে চলেছেন, ‘আজ পুরো হিন্দুস্তান জানতা হ্যায়, দুনিয়া ভি মানতা হ্যায়, মোদি কি গ্যারান্টি মলতব গ্যারান্টি পুরা হোনে কি গ্যারান্টি৷’ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জেনে গিয়েছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়ে কথা রাখেননি৷ মানে তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন৷ বছরে দু’কোটি চাকরি এবং প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা জমা হওয়ার প্রতিশ্রুতির লিখন এখন অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ সেসব কথা মোদি আর ভুলেও উল্লেখ করেন না৷ এবার বাংলার মানুষের কাছে তাঁর গ্যারান্টি, তিন হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে দেবেন৷ নিয়োগসহ বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্তে নেমে ইডি ওই বিপুল টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে৷ সংশ্লিষ্ট মামলাগুলিতে যাঁরা প্রতারণার শিকার টাকাগুলি তাঁদেরই ফেরাতে চান প্রধানমন্ত্রী৷ এজন্য তাঁর সরকার আইনি পরামর্শও নিচ্ছে বলে তাঁর দাবি৷

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ নাগরিক সমাজ যখন এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছে মরিয়া হয়ে, ঠিক তখনই বিপরীত বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বিজেপি৷ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও অর্থায়ন ছাড়া বিভিন্ন রাজ্যে ‘অপারেশন লোটাস’ চালানো ছিল অসম্ভব৷ ‘অপারেশন লোটাস’ অর্থাৎ অর্থের লোভ দেখিয়ে অন্য দল থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে এনে বিরোধী রাজ্য সরকারগুলিকে ভেঙে দেওয়া বা কব্জা করা৷ কিন্ত্ত এই বেহিসেবি টাকার উৎস কী? কিছু অসৎ ব্যবসায়ী এবং একাধিক শিল্পগোষ্ঠীকে নানাবিধ সরকারি সুযোগ পাইয়ে দেওয়া৷ যেমন ব্যাঙ্ক ঋণখেলাপিদের একাংশের মোটা অঙ্কের দেনা মকুব করে দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে সরকারি ব্যাঙ্ক ধুঁকলেও চিন্তার কোনও কারণ নেই৷ এইভাবে গত এক দশকে ধনবৈষম্য ভয়াবহ আকার নিয়েছে৷
এরপরই উল্লেখ করতে হয়, মোদি সরকারের নির্বাচন তহবিল পূর্ণ করার জন্য ইলেক্টোরাল বন্ডের কথা৷ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে যে যত খুশি টাকা দাও কাকপক্ষীতেও টের পাবে না৷ তবে শেষ অবধি রুখে দাঁড়াল শীর্ষ আদালত৷ নির্বাচনী বন্ডকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করল আদালত এবং আদালতের নির্দেশে অসহায়ের মতো স্টেট ব্যাঙ্ককেও সব তথ্য ফাঁস করতে হয়েছে৷ ফলে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, বন্ডের সুফল দু’হাতে কুড়িয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি৷ দেখা গেল, কোনও কোনও সংস্থা তার লাভের প্রায় ১০০ গুণ বেশি টাকার বন্ড কিনে দিয়েছে বিজেপিকে৷ সরকারকে কানাকড়ি কর না দিয়ে বিপুল পরিমাণে কর মকুবের সুবিধা পেয়েছে একাধিক কোম্পানি৷ সরকারি কাজের বরাত বণ্টনের তালিকাতেও এদের ‘উজ্জ্বল’ উপস্থিতি বন্ড কেনার কারণে৷ স্টেট ব্যাঙ্কের তালিকা অনুযায়ী এরকম পাঁচটি বিতর্কিত সংস্থা মিলেই শাসক দলকে দিয়েছে ৬০০ কোটি টাকা৷

মোদির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের স্বামী অর্থনীতিবিদ পরকলা প্রভাকর আগেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘মোদি সরকারের আবিষ্কার নির্বাচনী বন্ডই হল বিশ্বের বৃহত্তম দুর্নীতি৷’ এরই সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হল আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিংয়ের বিস্ফোরক দাবিটি৷ তিনি বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর দেশের সর্ববৃহৎ দুর্নীতিবাজ দলের নাম বিজেপি৷’ দেশের অর্থনীতির ভরাডুবি ঘটিয়ে গেরুয়া দলের অর্থভাণ্ডার কানায় কানায় পূর্ণ করার অনাচার হয়েছে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে৷ পশ্চিমবঙ্গসহ সিঙ্গল ইঞ্জিন রাজ্যগুলির গরিব মানুুষের একাধিক প্রকল্পের টাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে৷ অথচ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি বঙ্গে এসেও শত চেষ্টাতেও বহু চর্চিত দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় সররকারকে৷ উল্টে কয়েকটি বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, একাধিক বিভাগীয় মন্ত্রী ও পদাধিকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে৷ ভোট যত এগিয়ে আসছে বিরোধীদের এই কায়দায় বেকায়দায় ফেলার তৎপরতা বেড়ে উঠেছে৷ রাজনৈতিক মহলের খবর— দিল্লি, বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক প্রভৃতি বহু রাজ্যে গোহারা হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে বিজেপি৷
সাধারণ মানুষের আস্থা হারাচ্ছে মোদি সরকার৷ অবস্থা ফেরাবার শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ সাধনায় মন দেওয়ার থেকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে এজেন্সি লেলিয়ে দেওয়াই তো সহজ কাজ৷ সেই সহজ কাজেই মন দিয়েছে পদ্ম শিবির৷ এখন ঘোলাজলে মাছ উঠবে কিনা, সেটাই দেখার৷