অভিযুক্তকে প্রশয় মোদীর

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

একজন ব্যবসায়ী, যাঁর বিরুদ্ধে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, অবৈধ খনি, সোনা চোরাচালান ও কর ফাঁকির একাধিক অভিযোগ, তাঁকেই এখন মোদী সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রক ভারতের চাল রপ্তানির মূল দায়িত্ব দিয়েছে। সেই ব্যবসায়ীর নাম প্রেমচন্দ গর্গ।

গর্গ বর্তমানে ইন্ডিয়ান রাইস এক্সপোর্টার্স ফেডারেশন (আইআরইএফ)-এর প্রধান, যা কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসাবে কাজ করছে। মন্ত্রকের সহযোগিতায় আইআরইএফ আয়োজন করছে ‘ভারত ইন্টারন্যাশনাল রাইস কনফারেন্স ২০২৫’, যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে উদ্বোধনের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
প্রেমানন্দ গর্গ একসময় পরিচিত ছিলেন চাল ব্যবসায়ী হিসাবে। এখন তাঁর পরিচয় আরও আলোচিত একাধিক, তদন্ত সংস্থার অভিযুক্ত হিসাবেই। ২০১৯ সালে সিবিআই গর্গের বিরুদ্ধে ৯৭৯ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতি মামলায় চার্জশিট জমা দেয়। পরে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি) তাঁর বিরুদ্ধে সোনা চোলাচালান ও মানি লন্ডারিং মামলা শুরু করে। কর্ণাটকে অবৈধ খনি চালানোর অভিযোগে গর্গ আদালতে সাত বছরের কারাদণ্ড পান। এছাড়া নাইজেরিয়াতেও ব্যাঙ্ক প্রতারণার মামলা রয়েছে তাঁর নামে।

তবুও আশ্চর্যের বিষয়, এমন একজন অভিযুক্ত ব্যবসায়ীকে বাণিজ্য মন্ত্রক ‘নন-বাসমতি রাইস ডেভলপমেন্ট ফান্ড’-এর বোর্ডে বেসরকারি প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ করেছে। ফলে দেশের রপ্তানি নীতি, দামের গঠন এমনকি রপ্তানির সময়সূচিও এখন গর্গের মতো বিতর্কিত ব্যক্তির হাতে।


গর্গ পরিবারের ব্যবসা আজ ভারতের চাল রপ্তানির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁর দুই ছেলে আদিত্য গর্গও দেবাশিস গর্গ পরিচালনা করেন ভি এক্সপোর্ট ও এক জিমওয়ালা সলিউশন (সিঙ্গাপুর) নামে দু’টি সংসআথা, যারা ইতিমধ্যেই চার লক্ষ টনের বেশি চাল বিদেশেরপ্তানি করেছে।

এই সাফল্যের পেছনে সরকারি অনুমোদন ও সংযোগের ভূমিকা স্পষ্ট। গর্গের পরিচালিত আইআরইএফ এখন সরকারি সংস্থার সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু সরকারি রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে এই সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন গর্গ পরিবারের সদস্য এবং তাঁর পুরনো ব্যবসায়িক সহযোগীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রকের একজন প্রাক্তন আমলার কথায়, ‘এটা সম্পূর্ণ স্বার্থের সংঘাত। যিনি ব্যক্তিগতভাবে রপ্তানি ব্যবসায় যুক্ত, তিনিই এখন নীতি নির্ধারক সংস্থার শীর্ষে। এতে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে।’ বাণিজ্য মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি। প্রেমচন্দ গর্গ অবশ্য সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ‘সব মামলা বিচারাধীন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।’
তবে সরকারি দপ্তরের অভ্যন্তরে গুঞ্জন থামেনি। বিশেষ করে আইআরইএফ-কে কেন্দ্র করে ‘রাইস কনফারেন্স’-এর মতো উচ্চ পর্যায়ের আয়োজন সরকারের ‘অভ্যন্তরীণ ক্লিন চেকিং’-এর প্রশ্ন তুলেছে।
চাল ব্যবস্থায় প্রেমানন্দ শুরু করেন বিহারের ছোট শহর মোতিহারিতে। পরে তিনি দিল্লি ও কর্ণাটকে ব্যবসা বাড়ান। সরকারি প্রকল্পের টেন্ডার ও আন্তর্জাতিক রপ্তানি পারমিটের মাধ্যমে গড়ে ওঠে তাঁর নেটওয়ার্ক। অভিযোগ, সরকারি সংস্থাগুলির অডিট প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়েই তিনি কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

২০১৫ থেকে ২০২৩— এই আট বছরে গর্গ ও তাঁর সংস্থাগুলি ভারতের অন্তত ১২টি ব্যাঙ্কের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে যুক্ত ছিল। সিবিআই ও ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সময়ই ব্যাঙ্ক প্রতারণা, বোগাস বা ভুয়ো কোম্পানি তৈরি এবং কর ফাঁকির মাধ্যমে তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে।

তথ্যে প্রকাশ, প্রেমচন্দ গর্গ অন্তত পাঁচটি জালিয়াতি মামলায় অভিযুক্ত। তবুও তিনি এখন সরকারের অনুমোদিত রপ্তানি সংস্থার প্রধান। তাঁর পরিবারের কোম্পানিগুলি একই খাতে দ্রুত মুনাফা লুটছে। সরকারের কোনও প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ নেই।

যে ব্যবসায়ী একসময় কোটি টাকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতির জন্য আদালতে অভিযুক্ত, তিনিই আজ ভারতের চাল রপ্তানির সরকারি মুখ। আর এই পুরো প্রক্রিয়া চলছে সরকারের নীরব আশীর্বাদে। সরকারের নীরবতা এই প্রশ্ন তুলছে যে, নীতির শীর্ষে কি তবে স্বার্থের জাল ছড়িয়ে আছে?