২০১৩ সালে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন তৈরি করা হয়। আইন প্রণয়নের সময় বলা হয়েছিল, ভারতকে ‘ক্ষুধাশূন্য’ করে তুলতে দেশের তিনভাগের দু’ভাগ মানুষকে বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। কেন্দ্রীয় আইনটি মারফত দেশের প্রতিটি মানুষেরই খাদ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইনটি বলবৎ হওয়ার এক দশক পরও সকলের খিদের যন্ত্রণা দূর হয়নি। ইতিবাচক পরিবর্তনও হয়নি শিশু, মহিলা সহ গরিব পরিবারের স্বাস্থ্য চিত্রে। যক্ষ্মা বা টিবি-র মতো অপুষ্টিজনিত অসুখের সঙ্গে এখনও লড়তে হচ্ছে বহু মানুষকে। শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষায় এবং আন্তর্জাতিক আসরে খেলাধুলার ক্ষেত্রে ভারত যে বরাবর পিছিয়ে রয়েছে, তার একটি বড় কারণ হল এই দুর্বল স্বাস্থ্য।
অপুষ্টির শিকার সর্বাধিক সংখ্যার শিশু রয়েছে ভারতেই। ৬ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে ১৭ শতাংশের ওজন স্বাভাবিকের থেকে কম। ৫ বছরের কমবয়সি শিশুদের মধ্যে ৩৬ শতাংশের বৃদ্ধি ঠিকমতো হয়নি। তাদের মধ্যে ১৯ শতাংশের বৃদ্ধির সম্ভাবনাও আর নেই। এদের মধ্যে রক্তাল্পতায় ভুগছে অধিকাংশ। বিশ্ব ক্ষুধার সূচকে ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারত তাই রয়েছে ১০৫তম স্থানে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষায়, এক কথায়, ভারতের বেশির ভাগ মানুষের খিদের জ্বালা ভয়াবহ। এটা মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারের পরিপন্থী।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মাদী বলেছিলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিজেপি সরকার দেশের ৮০ কোটির বেশি গরিব মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার প্রকল্প আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেবে।’ এই ঘোষণা ছিল ৪ নভেম্বর, ২০২৩ ভোটমুখী ছত্তিশগড়ের দুর্গ এলাকায়। ২০২৪ সালের লোকসভার ভোটের কথা মাথায় রেখেই এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদী। তিনি অবশ্য তাঁর এবং বিজেপি সরকারের ‘মানবিক মুখ’ তুলে ধরতেই এই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধির কোনও মানুষ এর মধ্যে মোদী সরকারের বাহাদুরি খুঁজে পায়নি, বরং লজ্জিতই হয়েছিল। কারণ যে দেশের ৮০ কোটির বেশি মানুষকে বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে ভাত বা রুটি জোগাড় করতে হয়, সেই রাষ্ট্রের প্রকৃত হাঁড়ির হাল এতেই ধরা পড়ে।
স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও ভারতের মতো এক বৃহৎ ও শস্যশ্যামলা দেশের এই হাল কেন? প্রথম কারণ, তীব্র বৈষম্য, যা হ্রাসের বদলে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দ্বিতীয় কারণ, চরম অদক্ষ সরকারি ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি। মোদী জমানায় গত সাড়ে পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১৯-২০ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে ১,৮২৩ কোটি টাকার খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়ার দুঃসংবাদ জানা গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এক অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে অবশ্য এর জন্য গুদামের অভাবকে দায়ী করেছে। গুদাম থেকে রেশন দোকানে খাদ্যশস্য পাঠানোর পথেই ৬.২১ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ১,৮২৩ কোটি টাকা। এতো মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের খতিয়ান। এই নষ্ট-সংস্কৃতি যে দেশের এবং যে ব্যবস্থার মজ্জাগত, সেখানে পূর্ববর্তী বছরগুলিতেও যে বিপুল খিদে মেটানোর বিপুল সামগ্রী জলাঞ্জলি গিয়েছে, এটা বুঝতে সময় লাগে না।
খিদের জ্বালায় জর্জরিত দেশে এই ঘটনা মোটেই স্বাভাবিক নয়। পর্যাপ্ত সংখ্যক গুদাম নির্মাণ হয়নি কেন? আরও হিমঘর বা কোল্ড স্টোরেজ তৈরি হয়নি কেন? অভাবটা কিসের? অর্থের, না সদিচ্ছার? অর্থের অভাবের দোহাই সরকার দিতেই পারে, কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এই যুক্তি সামনে আনা যায় যে, বছর বছর যত টাকার খাদ্যশস্য নষ্ট হচ্ছে তার এক ভগ্নাংশ অর্থেই দেশজুড়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক উন্নতমানের গোডাউন তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। এতে খাদ্যের অপচয় বন্ধ হবে সরাসরি। অন্যদিকে সহজ হবে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই এবং কৃষকের হাতেও তুলে দেওয়া যাবে বাড়তি অর্থ। কিন্তু যাদের অপদার্থতার জন্য ধারাবাহিকভাবে দেশের এই ক্ষতি হয়ে চলেছে, তাদের চিহ্নিত করে কেন উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে না? আসলে, সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে।